প্রভাতকিরণ

Prabatkiron

লেখিকাঃ- ইসরাত জাহান দ্যুতি

প্রভাতকিরণ ইসরাত জাহান দ্যুতির প্রথম প্রকাশিত একক বই। বইটি একটি মধ্যযুগীয় রোমান্টিক জনরার বই। শুধুই রোমান্টিক নয়, এখানে রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, প্রবল সাহসিকতার চিত্র ফুটে ফুটেছে। বইটিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হলো, পরিবারের কাছে হেরে গিয়ে নিজের ভালোবাসাকে কবর দেওয়া, প্রকাশ না করা। হিংস্র রূপ থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।

এতসব কিছু বিবেচনা করে লেখিকা নিজস্ব প্রতিভায় মুগ্ধ করে তুলেছে বইটি। বইটি পড়তে গিয়ে এমন কোনো পাঠক থাকবে না যে মুগ্ধ হবে না। এক চমকে মন ভালো করার মতো একটি বই। তাহলে বই আলোচনা এতটুকুতেই থাক!

প্রভাতকিরণ! নামটা দেখেন? কত সুন্দর!

নিশ্চয়ই আপনাদেরও বিস্ময় করে তুলেছে নামটি? আমাকেও মুগ্ধ করেছিল এ নামটি। নামে মুগ্ধ হয়ে কি বইয়ের মজা পাব? বই পড়েই তো এ নামের উৎস বের করতে হবে আমাদের। তাই না?

তাহলে আসুন, আমি কীভাবে এ নামের উৎস খুঁজে পেলাম। তার কিছু অংশ আপনাদের সাথে আলোচনা করি।

বইটি জুড়ে যাদের সর্বপ্রথম বিশেষ ভাবে রাজত্ব। যাদের জীবনকে ঘিরে এ বইটি ফুলের সুবাসের মতো ফুটে উঠেছে। তারা দু’জন হলো, সম্রাট ফালাক তাজ আর শেহজাদি হিমানী মেহেরুন।

তারপর আছে কিছু চরিত্র যা বইটির সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আবু রাজ্জাক, যিনি ফালাকের পালকপিতা। ফালাকের বয়স যখন তের তখন থেকে তিনি ফালাককে কোলে পিঠে করে চড়িয়ে বড় করে তুলেছেন। শেহজাদা আহাদ, জুলেখা, সম্রাট জাভেদ খান, আরব খান, সেনাধ্যক্ষ ইসহাক, সম্রাট জাবেদের বেগম আফিয়াসহ আরো অনেক দাসদাসী, উজির, সেনাপতির চরিত্র এই বইতে বিদ্যমান। সবার বর্ণনা দিতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে।

সম্রাট ফালাক তাজ! যার সম্পদের কোনো শেষ নেই। ষোলটি সম্রাজ্যের অধিকারী সে। তার বাইরের চারিত্রিক কিছু বৈশিষ্ট্য, সে একজন ধর্মহীন, রমণাভিলাষী, হিংস্র স্বভাবের জালিম সম্রাট। বই পড়তে গিয়ে শুরুতে আমরা জানতে পারব ফালাক একজন দয়া মায়াহীন মানব, কিন্তু অনাথ আর বাচ্চাদের প্রতি তার মায়া অসীম। রঙবেরঙের পুষ্প, পুষ্প বাগিচা আর তার খুশবু খুবই প্রিয় তার। পুষ্পরানী সতেজ লাল গোলাপ তার অধিক প্রিয়।

আর মেহেরুন! সে যেমন একজন শেহজাদি। তেমন শেহজাদি হিসেবে সে কোনো বিলাসিতায় নেই। একজন বীর শেহজাদার মত তার মধ্যে সব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। একজন নারী হিসেবে তার এতটুকু কাম্য নয়। তবুও সে সবকিছুতে পারদর্শী। এমনকি যুদ্ধেও একজন দক্ষ বীরের সাথে লড়াই করে জয়ের ক্ষমতা রাখে সে। তাহলে আমরা বুঝতে পারি যে, সে যেমন তেমন একজন নারী নয়। সে নিশ্চিন্তে একজন সাহসী নারী। শুধু সাহসী নয়, মহাসাহসী। পশু শিকার তার একদমই পছন্দ নয়। কিন্তু সেই পশু শিকারে আসে একদিন শেহজাদা আহাদ। ভাগ্যক্রমে শেহাজাদা মুখোমুখি হয়ে যায় শেহজাদি মেহেরুনের কাছে। যিনি সম্রাট ফালাকের সৎ ভাই হিসেবে পরিচিত। হিমানী মেহেরুন তার দুঃসাহসিকতা দেখে ক্রোধে ফেটে পড়ে। সেই আহাদের সূত্র ধরে শেরপুর রাজ্যে ফালাকের আগমন ঘটে। আর এই ফালাকের আগমনই শেরপুর রাজ্যকে অন্ধাকারে ডুবিয়ে দেয়। ফালাক যেহেতু রমণাভিলাষী, তাই ফালাকের চোখ হিমানীকে দেখে সেখানেই আবদ্ধ হয়ে যায়। আপনারা কীভাবে ভাবেন? এই সম্রাট ফালাক তাজ হিমানীকে ছেড়ে দিবে?

তারপরে ঘটে দুই রাজ্যের মাঝে এক মর্মান্তিক যুদ্ধ। যেখানে মেহেরুনের পুরো পরিবার বন্দী হয়ে যায় ফালাক তাজের হাতে।

শেহজাদিও কি কম? সে তার সাধনায় অসাধ্য সাধন করতে চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে নিজের পরিবারকে মুক্ত করতে। কিন্তু হিমানী কি পেরেছিল তার রাজ্যকে ফালাকের হাত থেকে মুক্ত করতে?

এখানে এসে ফালাক হিমানীতে আবদ্ধ হয়ে যায়। কোথায় তার রমণাভিলাস, কোথায় তার হিংস্রতা? খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। আর হিমানী তার সেই দূর্বলতার খুত ধরে আরো একটি মর্মান্তিক কান্ড ঘটিয়ে বসে। যেখানে ফালাকের জীবনে নেমে আবারো ঘোর অন্ধকার। কিন্তু এমনটি কি হতে পারে না যে, হিমানীও ফালাকের প্রেমে পড়েছিল?

তাহলে একটি বাক্য আমি এখানে উপস্থিত করছি, যে বাক্য দিয়ে আপনারা বুঝে নিন, ফালাক আর মেহেরুনের দুরত্ব ঠিক কতটুকু!

পেটের মাঝখানটাতে হাত রেখে সেখানে চেয়ে হিমানী কাঁদতে কাঁদতে বলল,

– “একজনের মায়া এখন অবধি ছাড়তে পারলাম না। এর মাঝে আবার তুমি কেন এলে? তোমার অস্তিত্ব যে আমাকে ক্ষণে ক্ষণে ওনার কথা স্মরণ করিয়ে দিবে। এত যন্ত্রণা আমি কী করে সহ্য করবো বলো? আমার যে এত সহ্য ক্ষমতা নেই। নিঃশেষ হয়ে যাব আমি।”

পাঠক্রিয়া এতটুকু! আরো বলতে গেলে পুরো বইয়ের মূলভাব এসে যাবে। যা রিভিউতে গ্রহণযোগ্য না।

একজন মানুষ কোনো এক সমস্যায় পতিত না হলে যেমন নিজের গুরুত্ব বুঝতে পারে না, তেমনই কোনো পরিস্থিতির স্বীকার না হলে অত্যাচারী, হিংস্র হতে পারে না। তাহলে ফালাক কেন এতটা হিংস্র? আমরা কি ধরে নিতে পারি না যে, তার জীবনেও একটা মর্মান্তিক অতীত ঘিরে আছে?

না হলে ফালাকের দূর্বলতা নিয়ে হিমানী মর্মান্তিক ঘটনা ঘটিয়েছিলো কীভাবে? ফালাক তো তেমন কোনো দূর্বল পুরুষ না। যাকে একটা নারীর কাছে হেরে যেতে হবে। কিন্তু কী এমন সেই দূর্বলতা?

ফালাকের জীবনের পালকপিতা কেন? তার পিতামাতা বা কোথায়?

এতগুলো প্রশ্নের উত্তর আর রহস্য উন্মুক্ত করতে পড়তে হবে প্রভাতকিরণ বইটি।

বইটিতে মাঝখানের কিছু স্বার্থপর পরিস্থিতি, কঠোরভাবে ভালোবাসা প্রকাশ, আমাকে একদম কাঁদিয়ে ছেড়েছে।

একজন স্বাভাবিক নারী কোনোদিন তার পরিবারকে ছেড়ে নিজের ভালোবাসাকে প্রধান্য দিতে পারবে না, এটা বইটি পড়ে জানতে পারলাম। কারণ তার কাছে সর্বপ্রথম ভালোবাসা হচ্ছে তার পরিবার, পরে আসে নিজের ভবিষ্যত ভালোবাসা। তাইতো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হয় পরিবারকে। এই অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে হিমানীকে কম কাঁদতে হয়নি। এটাই বইয়ের সবচে চুম্বক অংশ।

এবার আসা যাক বইয়ের নাম প্রভাতকিরণ কেন? বইটি পড়লেই জানতেই পারবেন হিংস্র মানব ফালাকের জীবনে প্রভাতকিরণ কে!

কীভাবে এই ফালাকের জীবন অন্ধকার থেকে আলোয় পরিণত হয়?

সবকিছুর রহস্য বইয়েই বিদ্যমান।

আমি আমার ভাবনায় বইয়ের একটি চুম্বক অংশ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারি,

– “আমার মতো নারীলোভী ব্যক্তির লোভকে তুমি সংবরণ করেছ মেহের। কী দেখেছি আমি তোমার মাঝে তা আমি নিজেও জানি না। এতগুলো সময় তোমার সাথে আমার পার হয়ে গেল, কিন্তু এখনো তোমার শরীরকে আমার ভোগের সামগ্রী রূপে ভাবতে পারছি না। ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে চলেছি, স্বামীরূপে কবে তোমার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাবো! তুমি ভাবতে পারছ কতখানি ধৈর্যধারণ করেছি আমি! এই তিন মাহিনার মধ্যে আমার অন্য কোনো নারীর প্রতিও লোভ জাগেনি। তবে সৃষ্টিকর্তা যা রূপ দিয়েছে তোমায়! না জানি কতকাল নিজেকে ধরে রাখতে পারব। তোমাকে ঘিরে আমার মাঝে কতখানি আসক্তি বিরাজ করছে তা তোমায় বোঝাতে পারছি না মেহের। যেমন এই মুহুর্তে আমার ইচ্ছে করছে খুব শক্ত করে তোমাকে জড়িয়ে ধরে একদম নিজের বুকের মাঝে ঢুকিয়ে রাখি। তোমার শরীরে লোমের সংখ্যা যত বেশি, আমার আদর তার চেয়েও বেশি করে তোমায় অর্পণ করি। এই ইচ্ছা পূরণার্থে কৃপা করবে কি আমায়?”

এমন আকুলতা কেন ফালাকের?

শেষ পর্যন্ত কি মেহের পেরেছিল তার এই আকুলতাকে প্রধান্য দিতে?

বইটির সবকিছু আমাকে মুগ্ধ করেছে। মুগ্ধ করেছে মেহেরুনের ধার্মিকতা। আমি এই বইয়ের ক্ষতিকর কোনো দিক পাচ্ছি না। যা আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারব। এই বইকে আমি ১০/১০ তে মার্ক দিতে রাজি।

সর্বশেষে লেখিকার জন্য শুভ কামনা ও ভালোবাসা। আমাদের মাঝে এত সুন্দর আনন্দ মুখর একটি বই তুলে দেওয়ার জন্য। এখনো আমি আমার মন খারাপ হলে বইটি পড়তে বসি। আমার হঠাৎ করে মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। আমি জানি, বইটি পাঠককে এককথায় মুগ্ধ করে ছাড়বে। আপনারাও বইটি সংগ্রহ খুব শীঘ্রই পড়ে নিন।

ধন্যবাদ এত কষ্ট করে সামান্য এই লেখা পড়ার জন্য। প্রিয় বইয়ের রিভিউ লিখতে গেলে হাত কাঁপে। লিখতে পারি না। জানি, তেমন সুন্দর করে রিভিউ ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। তবুও চেষ্টা করলাম।

ইমেজঃ সংগৃহীত

মন্তব্য করুন