একটা আধখাওয়া চাঁদ ডুবে গেল

58737255

লেখক : রাসেল ওয়াহিদ

বনলতা, জলে ভাসতে থাকা কচুরিপানার মতো একটা চরিত্র। ধর্ম, জাত-পাত কিংবা শিক্ষা— তার জন্য আলাদা কোনো পরিচয় বহন করে না। সভ্য সমাজে মাথা উঁচু করে জীবন-যাপনের মতো পরিচয় তার নেই। শরীর বিক্রির টাকায় একটা সংসার চালাতে হয় তাকে। তার কাছে মাথা উঁচু করে জীবন-যাপনের চেয়ে জীবনটা বাঁচিয়ে রাখাই মুখ্য।

আমাদের সমাজে এমন হাজারো ‘বনলতা’র হাজারটা জীবন-গল্প আছে। আমরা ক’জন সেসব গল্প জানার কিংবা শোনার আগ্রহ নিয়ে তাদের কাছে যাই? কিন্তু ‘একটা আধখাওয়া চাঁদ ডুবে গেল’-তে বনলতার গল্প শুনতে এসেছিল বিখ্যাত লেখক ভাস্কর দে ধ্রুব। একসময় বনলতার এই জীবন-গল্প একটা বই আকারে প্রকাশ করেন তিনি।

গল্পের আরেক প্রধান চরিত্র বিদেশ ফেরত উৎপল। পেশায় একজন আর্টিস্ট। তার আয়োজিত একটা এক্সিবিশনকে ঘিরে কিছু রহস্য, গল্পের প্রায় শেষ পর্যন্ত টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।

বেণুর সাথে প্রথমদিকে শুধুমাত্র খুনসুটির সম্পর্ক লক্ষ করা গেলেও গল্পের ধারাবাহিকতায় একসময় তা সত্যিকারের ভালোবাসায় রূপ নেয়। কিন্তু উৎপলের দোটানা মনোভাব সেই ভালোবাসায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেয়।

সেই প্রশ্নবোধক চিহ্ন বিস্ময়সূচকে পরিণত হয় তখন, যখন গল্পে নামকরা আর্টিস্ট নিলুফা ইয়াসমিনের আগমন ঘটে। তার অপহরণের ঘটনার মাধ্যমে গল্পে আরেকটা সাসপেন্স তৈরি হয়।

উপন্যাসের শেষদিকে নামকরা এই শিল্পীর কাটা মুণ্ডু প্রদর্শনের মাধ্যমে চরিত্রটার ইতি টানা হয়।

উৎপল তার কর্মফল ভোগ করছিল।

বনলতা, বেণু— এই দুটো চরিত্রের শেষ পরিণতি দুঃখদায়ক হলেও গল্পের পরিপূর্ণতায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

নিলুফা ইয়াসমিন অকালে কেন তার প্রাণ হারালো; উৎপল কীসের কর্মফল ভোগ করছিল; বনলতা, বেণুর শেষ পরিণতি কী হয়েছিল— এসব জানতে হলে আপনাকে পড়তে হবে ‘একটা আধখাওয়া চাঁদ ডুবে গেল’ উপন্যাসটি।

পাঠ-প্রতিক্রিয়া :

আজকাল যেসব গল্প পড়ে আমরা অভ্যস্থ, সেসব গল্পের ভিড়ে এই গল্পটা একদমই ভিন্ন ধাঁচের ছিল বলে মনে হয়েছে। গল্পের প্লট, ডেভেলপমেন্ট, চরিত্রের বর্ণনা সবকিছুতেই লেখক তার অসাধারণ লেখার হাতের ছাপ রেখেছেন।

বনলতা, তার বন্ধু আতিক, উৎপল, উৎপলের ছোটভাই অমল, তাদের মা বিমলা দেবী, বেণু সবগুলো চরিত্রকে লেখক বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে তৈরি করেছেন।

বনলতা এবং বেণুর মধ্যকার সম্পর্ক আগে থেকে আঁচ করা গেলেও, টুইস্ট ছিল।

ভিন্ন ধর্মের চরিত্রগুলোর বর্ণনা, পরিবার, আচার সবকিছু দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। এটা লেখকের জন্য অন্যতম সার্থকতা।

বনলতার জীবন-যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার গল্প প্রথম থেকে শেষ অবধি পাঠককে এক অন্যরকম শিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

বেণু আর উৎপলের অল্পস্বল্প প্রেমের গল্প বেশ স্নিগ্ধ ছিল।

আবার, বনলতার সাথে আতিকের ‘না হওয়া’ ছোট একটা প্রেমের গল্পও লেখক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। উপন্যাসের শেষের দিকে যদিও আতিক চরিত্রটা পাঠক মন ক্ষুণ্ন করেছে, তবু এই সম্পর্কটা মিষ্টি ছিল।

অগণিত ‘বনলতা’-দের স্বপ্ন থাকে, ইচ্ছা থাকে— পরিবারের মুখে দুবেলা ভাত তুলে দেওয়ার প্রয়োজনে সম্পূর্ণ আলাদা যে এক জীবন তারা বেছে নেয় সেই জীবন থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার। হয়তো সম্ভব। কিন্তু সম্ভব তখন, যখন এই স্বাভাবিক সমাজের ‘আমরা’ তাদের প্রতি সাহায্যের একটা হাত বাড়িয়ে দিতে পারব। লেখক তার লেখার মাধ্যমে বারবার আমাদের কাছে এই বার্তাটা পৌঁছে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন এবং তিনি তার চেষ্টায় সফল বলে মনে করি।

নামকরণে সার্থকতা :

প্রথম যেদিন লেখকের টাইমলাইনে বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি দেখলাম, প্রচ্ছদের সাথে নামের মিল খুঁজার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কোনো মিল পাইনি।

বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা থেকেই উপন্যাসের নামকরণের রহস্যটা খুঁজছিলাম। কিন্তু গল্পের সাথে নামকরণের চেয়ে প্রচ্ছদের মিলটাই বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছিল।

অবশেষে ৪৭ পৃষ্ঠায় এসে প্রথম নামকরণের পেছনের কারণ জানতে পেরেছি। বনলতার জীবন-গল্প নিয়ে উপন্যাসের ‘লেখক’ চরিত্র ভাস্কর দে ধ্রুব-র লেখা উপন্যাসটার নাম ছিল ‘একটা আধখাওয়া চাঁদ ডুবে গেল’।

তারপর একেবারে শেষ অধ্যায়ে আধখাওয়া চাঁদের সাথে বনলতা কিংবা বেণু চরিত্রের জীবনের পরিণতি মিলিয়ে লেখক যে বেদনাপূর্ণ দৃশ্য অঙ্কন করেছেন, তা প্রশংসনীয়। এবং এখানেই নামকরণের সার্থকতা নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে।

মন ছুঁয়ে যাওয়া পঙক্তি :

“হ্যাঁ, সে নরকবাসী, সে পাপী, সে অচ্ছুত। কিন্তু এই পাপী-তাপী, অচ্ছুত মেয়ের পয়সাতেই একজন বাবার চিকিৎসা হয়, একটা পরিবারের ভরণপোষণ হয়। এসব কেউ দেখে না। সবাই উঁচুতে বসে নিচের দিকে থুতু ফেলে।”

“আচ্ছা, ওই যে আধখাওয়া চাঁদ, ওর সাথে কি কোনোই তফাৎ আছে তার জীবনের? নেই। এতটুকুও তফাৎ নেই। যেন ওই আধখাওয়া চাঁদখানা তারই জীবনের প্রতিচ্ছবি।”

২৩ পৃষ্ঠায় বিমলা দেবীর সংলাপ – “জানিস তো, বুয়ার হাতের রান্না খেতে পারি না।”

হিন্দুরা সাধারণত কাজের মেয়ে/মহিলাকে ‘বুয়া’ সম্বোধন করে না।

৪২ পৃষ্ঠায় “মায়ের ডাক শুনে ক্যানভাসে আঁকিবুঁকি করতে থাকা অমল রঙতুলির খেলা থামাল।” লাইনটিতে খুব সম্ভবত টাইপোর কারণে উৎপলের জায়গায় অমল চলে এসেছে।

প্রথম অধ্যায়ে বনলতা এবং লেখক ভাস্কর দে ধ্রুব চরিত্র দুটোর বর্ণনা শেষে, পরবর্তী ছয় অধ্যায়ে তাদের কোনো গল্প আসেনি। অষ্টম অধ্যায়ে আবার এই দুটো চরিত্রের দেখা মিললেও আমার কাছে মনে হয়েছে, তৃতীয়-চতুর্থ অধ্যায়ে আবার বনলতাকে রাখতে পারলে গল্পের ধারাবাহিকতা আরেকটু সুন্দর হতো।

উপন্যাসে ‘লেখক’ চরিত্রটার একটা পরিণতির অভাব বোধ করেছি। ‘চমৎকার শুরু’-তে থাকা একটা চরিত্রের পরিণতি না থাকায় খারাপ লেগেছে।

বইয়ের প্রচ্ছদ ও কোয়ালিটি :

প্রচ্ছদ নিঃসন্দেহে গল্পের সাথে একদম মিলেমিশে গেছে। শুধু একটা আধখাওয়া চাঁদের অভাব রয়েছে।

হলুদের বদলে স্কাই-ব্লু কালার থাকলে এবং উপরের দিকে এক কোণায় একটা আধখাওয়া চাঁদ থাকলে আরো বেশি ভালো লাগত বলে মনে করি।

বইয়ের কোয়ালিটি দেখে হতাশ হয়েছি। পার্টেক্স (ক্রিম/অফ হোয়াইট) কাগজে প্রিন্ট হলেও কাগজ বেশ পাতলা ও নিম্নমানের। প্রতি পৃষ্ঠার ভাঁজে ভাঁজে কালচে দাগ পড়ে গেছে। কাভারের আঠাও ছুটানো ছিল।

তবে আর্টপেপারে এমবোস ও লেমিনেশনসহ কাভারটা মোটামুটি ভালো।

সব মিলিয়ে লেখকের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ‘একটা আধখাওয়া চাঁদ ডুবে গেল’ বেশ সুখপাঠ্য মনে হয়েছে। ভিন্ন ধাঁচের শিক্ষণীয় গল্পটি সবার পড়া উচিৎ বলে মনে করি।

লেখকের জন্য ঢের শুভকামনা রইল।

ইমেজঃ সংগৃহীত

মন্তব্য করুন