
এই উপন্যাসের লেখক পাউলো কোলো রূপকথার মোড়কে এমন কিছু জীবন শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন যে বইটি আপামর জনসাধারণের কাছে ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মূল উপন্যাসটি পর্তুগিজ ভাষায় লেখা হলেও এখনো পর্যন্ত আশিটিরও বেশি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। এটি ইন্টারন্যাশনাল বেস্টসেলার হিসেবেও গণ্য হয়। তাহলে চলো ছোট্টকরে গল্পটা জেনে নিই, তারপর আলোচনা করবো বইটা পড়ে আমি কি কি শিখলাম এবং সবশেষে বইটার থেকে বিশ্ববিখ্যাত কয়েকটি উক্তি তুলে ধরবো।
সান্টিয়াগো নামে স্পেনের এক ভেড়াপালক প্রায় রোজ রাত্রেই স্বপ্ন দেখে মিশরের পিরামিডে মাটির নিচে অনেক গুপ্তধন লুকানো আছে। এই স্বপ্নের মানে জানার জন্য সে এক তান্ত্রিক বুড়ির কাছে যায়। বুড়ি তাকে জানায় তার স্বপ্নের মধ্যে নিশ্চয় কোনো ভবিষৎবাণী লুকিয়ে আছে তাই তার মিশরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া উচিত। এরপর সান্টিয়াগো তার ভেড়ার দলকে নিয়ে উলবিক্রির উদ্দেশ্যে শহরের দিকে রওনা দেয়।
যেতে যেতে পথে সন্ধ্যে নামে। রাত কাটানোর জন্য সে এক পরিত্যক্ত ভাঙা গির্জায় প্রবেশ করে। ঘুমিয়ে পড়তেই সান্টিয়াগো আবার সে সেই একই স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্নে একটি ছোট বাচ্চা এসে তাকে হাত ধরে মিশরের পিরামিডের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে যে সেখানে মাটির নিচে গুপ্তধন লোকানো আছে। এরপর এক বৃদ্ধ লোকের সঙ্গে তার দেখা হয় যে নিজেকে সালেমের রাজা বলে পরিচয় দেয়। তাকে নিজের স্বপ্নের কথা বললে সে তাকে মরোক্কো যেতে পরামর্শ দেয় যেখানে গুপ্তধন লুকানো আছে।
সেই বৃদ্ধের কথায় সে তার ভেড়াগুলিকে বিক্রি করতে রাজি হয় এবং তাঞ্জিয়ারের উদ্দেশে রওনা হয়। সেখানে সে এক ঠকের পাল্লায় পরে যে তাকে মিশরে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার ভেড়া বিক্রি করার সমস্ত টাকা নিয়ে পালায়। সর্বশান্ত হয়ে সে এক কাঁচ ব্যবসায়ীর দোকানে কাজ করা শুরু করে এবং এক বছরের মধ্যে অনেক টাকা জমিয়ে ফেলে। সে আবার ভেড়া কিনে আগের জীবনে ফায়ার যেতে চাই কিন্তু তার স্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তাই সে আবার গুপ্তধনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।
এক মরুযাত্রীদলের সঙ্গে সাহারা মরুভূমি পার হওয়ার সময় এক ইংরেজ সাহেবের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। তার সঙ্গে কথোপকথনের পর সান্টিয়াগো জানতে পারে যে সাহেব ২০০ বছরের বৃদ্ধ এক আলকামিস্টের কাছে যাচ্ছে আলকেমি বিদ্যার গোপন রহস্য জানতে। সান্টিয়াগো জানতে পারে ফিলোসফার্স স্টোন সম্পর্কে যার সংস্পর্শে যেকোনো ধাতু সোনায় রূপান্তরিত হয়।
যাত্রাপথে শত্রুদের আক্রমণের ভয়ে ফাইয়ুম নাম একটি জায়গায় মরুযাত্রীদল আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখানকার দলের সর্দারের সঙ্গে সান্তিয়াগোর ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে যখন বিপদের আঁচ করে সে সর্দারকে সতর্ক করে। তার সতর্কীকরণের জন্য ফাইয়ুম শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পায়। সর্দার খুশি হয়ে তাকে পুরস্কৃত করে। এখানে থাকতে থাকতেই ফাতিমা নামে এক মেয়ের সঙ্গে সান্তিয়াগোর পরিচয় ঘটে এবং সান্টিয়াগো তাকে ভালোবেসে ফেলে। ধীরে ধীরে নিজের স্বপপূরণের কথা ভুলে ফাতিমার সঙ্গে সেই মরুদ্যানে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার বাসনা তার মনে জাগে।
এমনসময় সেই ২০০ বছরের বৃদ্ধ আলকেমিস্টের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। বৃদ্ধ তাকে বোঝায় সত্যিকারের ভালোবাসা কোনোদিন কাউকে তার স্বপ্নপূরণের পথে বাধা দিতে পারে না। তাই তার উচিত ফাতিমার কথা ভুলে নিজের লক্ষ্য পূরণের পথে যাত্রা শুরু করা। অবশেষে আলকেমিস্টের সহায়তায় সান্টিয়াগো পিরামিডে পৌঁছতে সক্ষম হয়। নিজের লক্ষ্যের এত কাছাকাছি পৌঁছে সান্টিয়াগো আনন্দে নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। চোখের জল মাটিতে যেখানে পড়েছে সেখানে সে খুঁড়তে শুরু করে।
কিন্তু এমনসময় একদল ডাকাত তার এই কর্মকান্ড দেখে তার দিকে এগিয়ে আসে। তার কাছে তারা একটুকরো সোনা দেখতে পায় যা সে আলকেমিস্ট তামা থেকে রূপান্তরিত করে সান্টিয়াগোকে উপহার দিয়েছিলো। তার কাছে আরো অনেক সোনা আছে এইভেবে ডাকাতরা তাকে মারধর করতে শুরু করে। আধমরা অবস্থায় এসে সান্তিয়াগো তাদেরকে স্বপ্নে দেখা গুপ্তধনের কথা জানাই। এই শুনে ডাকাতদের মধ্যে একজন তাকে ব্যঙ্গ করে বলে সেও ঠিক একই স্বপ্ন দেখেছিলো। সে দেখেছিলো গুপ্তধন দূরের কোনো দেশে এক প্রাচীন ভগ্নপ্রায় গির্জায় মাঠির নিচে লুকানো আছে কিন্তু সে সান্তিয়াগোর মতো পাগল না যে নিজের স্বপ্নকে বিশ্বাস করে দূরদেশে সেই অনিশ্চিত গির্জার খোঁজে বেরিয়ে পড়বে। এই বলে ডাকাতদল তাকে পাগল ভেবে ফেলে রেখে চলে যায়।
রক্তাক্ত অবস্থাতেও সান্টিয়াগো আনন্দে হাসতে থাকে কারণ সে গুপ্তধনের রহস্যভেদ করে ফেলেছে। সে বুঝতে পারে গুপ্তধন সেখানে লুকানো আছে যেখান থেকে সে এসেছে। সান্টিয়াগো আবার ফিরে আসে সেই পরিত্যক্ত গির্জায় এবং মাটি খুঁড়ে গুপ্তধন উদ্ধার করে।
এই বইটি পড়ে কি কি শিখলাম:
১) সান্টিয়াগো মাটির নিচে যে গুপ্তধন পেয়েছিলো সেটা আসলে গুপ্তধন নয়। প্রকৃত গুপ্তধন হলো শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা। গুপ্তধন খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন ধরণের মানুষের সংস্পর্শে আসে এবং নানা বিপদসংকুল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। এইসব অভিজ্ঞতা তাকে মানুষ হিসেবে অনেক বেশি পরিণত করে তুলেছিল। আমরা কোনো কাজে অসফল হলে মুষড়ে পড়ি এবং ভাবি সব চেষ্টা বৃথা গেলো কিন্তু কাজটি করার সময় আমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি সেই শিক্ষা পরবর্তীকালে সফল হতে গুপ্তধনের মতো কাজ করে।
২) এখানে গুপ্তধনকে যদি সুখের সাথে তুলনা করা যায় তাহলে বোঝা যাবে যে সুখের সন্ধানে আমরা সারাজীবন ছুটে বেড়ায় তা আসলে আমাদের মনের মধ্যেই বর্তমান।
৩) নিজের স্বপ্নপূরণের পথে হাজার বাধাবিপত্তি আসবে। তাই বলে কখনোই হাল ছাড়া উচিত নয়।
৪) অনেকসময় লোকে কি বলবে সেটাকে আমরা এত বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি যে নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলি। কিন্তু কে কি বললো তাতে কান না দিয়ে নিজের ওপর বিশ্বাস করে এগিয়ে চলো, সাফল্য আসবেই।
৫) বর্তমানে বাঁচো। এটাই জীবন। অতীত বা ভবিষ্যৎ দুটোই অধরা। বর্তমান মুহূর্তগুলোকে উপভোগ করার নামই জীবন।
৬)নিজের হৃদয়ের কথা শোনো। যখন তুমি নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে অটল থাকবে তখন গোটা বিশ্বব্রম্ভান্ড তোমাকে সাহায্য করবে।
এবার এই উপন্যাসের কয়েকটি বিখ্যাত লাইন শেয়ার করবো আশা করি পাঠকদের ভালো লাগবে:
1. “When you want something, all the universe conspires in helping you to achieve it.”
2. “People are capable, at any time in their lives, of doing what they dream of.”
3. “It’s the simple things in life that are most extraordinary
4. “Because I don’t live in either my past or my future. I’m interested only in the present. If you can concentrate on the present, you’ll be a happy man.”
5. “Follow your personal legend.”
6. “You must understand that love never keeps a man from pursuing his Personal Legend. If he abandons that pursuit, it’s because it wasn’t true love…”.
7. “There is only one way to learn…It’s through action.”
তথ্যসূত্র এবং ইমেজঃ ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া