মার্জিনে মন্তব্য

18135911

লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক

‘মার্জিনে মন্তব্য’র ফ্ল্যাপে লেখা আছে, “লেখা শেখার বই এটি কোনো অর্থেই নয়। বরং একে লেখার কলাকৌশলের দিকে আমাদের চোখ ফেরাবার বই বলা যেতে পারে।” যথার্থই বলেছেন লেখক এই বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে খুব সুন্দর করে লেখার কলাকৌশলগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মজার ব্যাপার হল, কলাকৌশলের শুরুটাই করেছেন প্রেমপত্র দিয়ে। এরপর শিল্পী আর মিস্তিরি’ তে দেখিয়েছেন দুজনার পার্থক্য। এই সম্পর্কে লেখক বলেন “মিস্তিরি শিল্পী নন, কিন্তু প্রতিটি শিল্পীই নিপুন মিস্তিরি।” আবার আরেক গুণী চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরীর উদ্দৃতি দিয়ে বলেন, “আমার চিত্রকর বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরী একবার একটি কথা বলেছিলেন – আমরা মিস্তিরি মানুষ। এ বাড়িতে পোষাল না, র‍্যাদা-করাত-বাটালি চটের থলেতে পুরে অন্য গেরস্তর বাড়ি যাবো।” আহা কি সুন্দর কথা!

গদ্য পদ্যের বিভাজন, গল্পের নানান রস নিয়ে তিনি সাজিয়েছেন বইয়ের প্রথম অংশ। এছাড়া দ্বিতীয় অংশে ‘গল্পের কলকব্জা’য় লেখক দেখিয়েছেন রচনা কালে গুণী লেখকদের ভাবনা, প্রেক্ষাপট, চিন্তাধারা, মনন সাথে গল্পের প্রাসঙ্গিকতা। এই অংশে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প পোস্টমাস্টার, নিশীথে’র এক অপূর্ব আলোচনা করেছেন। শুধু এই দুই গল্পই নয় স্থান পেয়েছে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প তেলেনাপোতা আবিষ্কার, জগদীশ গুপ্তের দিবসের শেষে এবং মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ভংকর গল্পের মূল বিশ্লেষণ।

বইয়ের শেষ অংশ “কবিতার কিমিয়া”! কবিতা মানুষের আবেগের ফসল। অন্যভাবে বলা যায় আবেগ ছাড়া কবিতা অসফল। কিন্তু সব আবেগেই কি কবিতা হয়? কবিতা লেখার নানামুখী দিক নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে এই অংশে। কবিতা মানুষ কেন লেখে, কবিতার ছন্দ কি, কবিতা কি করে হয়, গদ্য-ছন্দ কি? ছবিতা কি? আছে কবিতা লেখায় কম্পিউটারের অবদানের কথা। সনেটের আদি রহস্যও উন্মোচিত হয়ে এই গ্রন্থে। কবিতায় শব্দের প্রয়োগ, নেরুদার সাবধান বাণীর সাথে এটাও বলা হয়েছে কবিরা কি প্রতিমাশিল্পী? মজার মজার সব কলাকৌশল আর দিকনির্দেশনায় ভরপুর কবিতার কিমিয়া। কবিতার নাড়ী নক্ষত্র জানতে এই অংশ ব্যাপক সমাদ্রিত হয়েছে উচ্চশ্রেণীর সমসাময়িক লেখক মহলে।

দারুণ সব উদাহরণ, কেইস স্ট্যাডিতে ভরপুর এই বই সত্যিকার অর্থেই একটি রচনার কলাকৌশল শিক্ষার বই। এত সুন্দর গতিতে এই বইটির অধ্যায়গুলো প্রবাহিত হয়েছে, এককথায় তা অসাধারণ। খুব সাবলীল এবং অর্থপূর্ণ যথার্থ শব্দ চয়নে রচিত এই বই নানা দিক থেকে গুরুতবপুর্ণ অর্থ বহন করে। এই নিয়ে লেখক বলেছেন, “… লেখা আমার কাছে প্রেমে পড়বার চেয়েও অনেক বেশী উত্তেজক ও ব্যক্তিগত, দূরাভিলাষী ও উড্ডয়নশীল। আমার এই বিশেষ প্রেমটির ইঙ্গিত ও ইতিহাস পাওয়া যাবে এই বইয়ে।” সত্যি তাই চমৎকার উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছে এই বই। যাকে বলে হৃদয়গ্রাহী।

লেখক ভূমিকায় লিখেছেন, “লেখাটা গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুর কাছে শিখতে হয় হাতেকলমে। গুরু সবসময় প্রত্যক্ষ কেউ নাও থাকতে পারেন- না থাকাটাই স্বাভাবিক। লেখা শেখা হয় অন্যের লেখা পড়ে, শেখা চলে পড়তে পড়তে, লিখতে লিখতে।” – এ যেন আমার মনের কথাটাই বলে গেছেন লেখক। আমি সমরেশ মজুমদারের লেখায় অনুপ্রাণিত, চেষ্টা করি উনার একটু ধাঁচ রাখতে। আর এই কথাটা আমি নিজেই জানতাম না যতদিন না আমি এই বইটা পড়েছি। এক অর্থে এই বই আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছে। প্রবল ভাবে নাড়া দিয়েছে আমার লেখক সত্তাকে। অনেক কিছু শেখার আছে এই বই থেকে, হয়ত সৈয়দ শামসুল হককে প্রত্যক্ষ গুরু হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি, তবে পরোক্ষভাবে উনাকেও আমি গুরু বলে মেনেছি এই রচনা পড়ার পর। আশা করি আপনাদেরও এই বইটি ভাল লাগবে।

ইমেজ- সংগৃহীত

মন্তব্য করুন