
কাজী নজরুল ইসলাম
এই উপন্যাসে নারীদের জীবনের দুর্বিসহ অন্ধকার সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কবি খুব সুন্দর ভাবে দারিদ্র্য মানুষের দুঃখ বেদনার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এই উপন্যাস টি কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়কের এক বস্তি এলাকায় সৃষ্ট। এই উপন্যাসে দেখা যাবে তৎকালিন সময়ের দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষের কিছু চিত্র, আরো দেখা যাবে সেই সময়ের সপরিবার মুসলিম থেকে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করার বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র রূবি আনসার নামক এক ছেলেকে ভালোবাসলেও সামাজিকতা মেনে নিতে গিয়ে তাদের মাঝে বিচ্ছেদ হয়। রুবির বাবা বিয়ে দিয়ে দেয় অন্য ছেলের সাথে। উপন্যাসের এক পর্যায়ে রুবির স্বামী মারা গেলে তার জীবনে নেমে আসে সমাজের অন্ধ বিধি নিষেধ এবং সমাজের কঠিন বাস্তবিকতার ছায়া। এই সব প্রতিকূলতার মাঝেই উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহ হতে থাকে।
‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের একটি অনন্য সাধারণ চরিত্র মেজবৌ।মেজবৌ অত্যন্ত সুন্দর দেহে যেমন মনেও তেমনি। অত্যন্ত উদার হৃদয়, স্নেহপ্রবণ, সহানুভূতিশীল।দারিদ্র্যের দগ্ধ মরুতে সে যেন এক সুশীতল মরুদ্যান।দরিদ্র ঘরের রূপসী বিধবার প্রতি লালসা আর কামনার দৃষ্টি কটাক্ষ, হাতছানি চারদিকে।এসব থেকে নিজেকে অত্যন্ত কৌশলে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ চরিত্রটি অপার সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয়েছিল। তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও বহির্দ্বন্দ্ব উপন্যাসের উৎকর্ষকে অন্য মাত্রা দেবার সুযোগ দিয়েছিল।কিন্তু নজরুল সে পথে যান নি। যথেষ্ট কারণ ছাড়াই ঔপন্যাসিক মেজবৌকে ধর্মান্তর করালেন। সে ছেলেমেয়ের খাওয়া-পরার জন্য খ্রিস্টান হলেন, তাদেরকে ফেলে রেখে চলে গেলেন অনেক দূরে- বরিশালে। আবার ছেলের অসুখের সংবাদ জেনে ফিরে এলেন বাড়িতে।তবে বাদ সাধে সন্তানেরা। তার ছেলেটি মারা যায়। মেজ-বৌকে ফিরে আসতে হয়
বস্তিজীবনে। কিন’ মেজ-বৌ মিশনারী মেম-সাহেবদের বহু অনুরোধেও আর ফিরে যায়নি আবার তৌবা করে মুসলমানও হয়নি।
উপন্যাসের দ্বিতীয় অংশের শুরু হয় আনসার-রুবি প্রসঙ্গে।
সমাজকর্মী, দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী ও সংসার-বিরাগী আনসার এসে আশ্রয় নিল লতিফা ওরফে বুচির বাসায়।লতিফার স্বামী স’ানীয় কোর্টের নাজির। পরে কৃষ্ণনগরের জেলা-ম্যাজিস্ট্রেটের তরুণী কন্যা সদ্য-বিধবা রুবির সঙ্গে শৈশব প্রণয়ের স্মৃতি আনসারের মনে উদয় হয়।যদিও রুবি-আনসারের পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটেছে উপন্যাসের শেষাংশে। মাঝখানে কয়েক বছর দু’জনের সাক্ষাৎ হয়নি।কারণ রুবির অমতে তার বিয়ে হয়েছিল অর্থলোভী এক যুবকের সঙ্গে।তাদের সংসার টিকে ছিল মাত্র একমাস।
বাইরের সাজসজ্জা ও আচরণ রুবির বিধবাসুলভ হলেও মনে প্রাণে সে আনসারকেই স্বামী বলে মানে। আনসার রাজবন্দী হয়ে রেঙ্গুনে চলে যায়, সেখানে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে সুস’ হবার আশায় ওয়ালটেয়ারে যায়। রুবি ওই সংবাদ শোনামাত্রই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াতে দ্বিধা করে না।আনসারকে রোগমুক্ত করতে রুবি অক্লান্ত পরিশ্রম করে কিন’ শেষ পর্যন্ত তাকে নিরাময় করতে অসমর্থ হয় এবং আনসার মারা যায়।এদিকে আনসারকে সেবাযত্নের ফলে একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে রুবি মারা যায়।
নজরুল যে ক’টি উপন্যাস রচনা করেছেন, তার মধ্যে শিল্পাঙ্গিক ও জীবনবোধের সফলতায় মৃত্যুক্ষুধা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। পশ্চিমবঙ্গে কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়কের নিুশ্রেণীর দরিদ্র হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান সমপদায়ের দারিদ্র্য ও দুঃখভরা জীবন নিয়ে উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে। তাদের একদিকে মৃত্যু আর একদিকে ক্ষুধা। সেখান থেকেই উপন্যাসের নামকরণ মৃত্যুক্ষুধা।
ইমেজঃ সংগৃহীত