নিয়তি – পর্ব ০৮

নিয়তি

কিডনি কামাল দূর থেকে কয়দিন ধরে নজর রাখছে ২৪/২ নম্বর বাসার সামনে। এই বাসায় নাকি পূলক সেনের মেয়ে নিয়মিত আস যাওয়া করে। এই সব নজরদারির কাজ তার না, কিন্তু পূলক সেনের সাথে তার একটা খুনের ব্যাপারে চুক্তি হয়েছিল, সেই চুক্তির ভিডিওটা কে যেন করে রাখছে, আর এখন ঐ ভিডিওটা দেখিয়ে ব্ল্যাক্মেইলিং করছে। কারন যে ছেলেটারে মারার কথা সেই ছেলেটা সে কিডন্যাপ করার আগেই নিখোঁজ। সাংবাদিক পূলক সেন মরে তারে ফেলে দিছে বিরাট বিপদে। পূলক সেন খুন হবার কয়দিন আগে, কিডনি কামালরে একটা ছেলেকে খুনের জন্য একটা দেখা করেছিলেন। একটা চেক ও দিয়েছিলেন এডভান্স হিসাবে, যেদিন ছেলেটাকে ঢাকা ভার্সিটি থেকে তুলে আনার কথা ছিল, আর যেসময়ে তুলে নেয়ার কথা ছিল সেদিনই ক্যম্পাস এলাকায় খুন হলো পূলক সেন। ক্যম্পাসে তুলকালাম অবস্থা, এরমধ্যে একটা জলজ্যান্ত ছেলেকে কিডন্যাপ করা সহজ কথা না। কামালে কাছে পূলক সেন লোকটাকেই অতি ধূরন্ধর লেগেছে। হাসতে হাসতে ভয়ংকর সব কথা বলে সে। পূলক সেন মারা যাবার পর কামাল গিয়েছিল চেক টা ক্যাশ করাতে, পারেনি। সরকার নাকি তার একাউন্ট গুলো ফ্রিজ করে রেখেছে। কামাল পূলক সেনের কাহিনী কিছুই বুঝতে পারছেনা। যে ছেলেকে তার তুলে আনার কথা সেই ছেলে ঐ দিন থেকে ক্যাম্পয়াসেই নাকি নিখোঁজ। সে তো কিডন্যাপ করেই নাই সেদিন ক্যাম্পাসে ঢোকার সাহস ও সে করেনাই। ৪২ টা খুন করে তার নাম হয়েছে কিডনি কালাম। তার খুনের একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে, সে কিডন্যাপ করে খুনের আগে কিডনি দুটো বিক্রি করে দেয় উচ্চ মুল্যে। তার বেশির ভাগ ক্রেতাই দেশি।

বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সাম্প্রতিক কালে তাদের এই অরগান ট্রান্সপ্লয়ান্টের চেইন টা সম্পর্কে কাজ করছিল, তার মাধ্যমেই কামালের সাথে পরিচয় পূলক সেনের। পুলক সেন লোকটা এম্নিতে দুই হাতে পয়সা খরচ করে। ভাবা যায়, এই লোক কোন কারন ছাড়াই তার কাছ থেকে কিডনি কেনার জন্য কিছু টাকা দিয়ে রাখছিল, কামাল জিজ্ঞেস করেছিল কার জন্য। হাসতে হাসতে পূলক সেন বলেছিল উনার নিজের জন্যই নাকি। কামালের অবশ্য কিডনির ব্যাবসা দীর্ঘদিনের, স্বেচ্ছায় অনেকে কিডনি বিক্রি করে, সেখানে খুব কম টাকায় কিডনি পাওইয়া যায়। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নাম সর্বস্ব ক্লিনিকের সাইনবোর্ড লাগিয়ে তারা এই ব্যাবসা করে।
গত শুক্রবার রাতে সে একটা অদ্ভুত কল পেয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে তার এই বাসার দিকে চোখ রাখা। এই লোক ফোন করে জানিয়েছে এই বাসার সামনে তার ডিউটি অবশ্যই ২৪ ঘ্ন্টার, পূলক সেনের মেয়েকে সব রকমের হেল্প যেন সে করে। পূলক সেনের মেয়েকে অবশ্য কামাল আগে চিনতো না, সিকিউরিটির কারনে কোন মিডিয়াতেই পূলক সেনের মেয়ে জয়া সেনের ছবি আসেনি। শুক্রবার রাতে তার সিক্রেট চ্যাটে যে মেয়ের ছবি এসেছে সে তো অস্মভব সুন্দরি। পুলক সেন দেখতে ছোট খাটো মানুষ হলে কি হবে, মেয়েটা তার বড়ই সুন্দর। ভাবতেই জিহবা দিয়ে ঠোঁট চ্যাটে সে। জয়া সেন এই বাসায় এই বুড়ির কাছে আসে বলে তার ধারনা। প্রায়ই বারান্দায় এক বুড়িকে নিয়ে দাঁড়ায়। যে তাকে কল করছিল সে অবশ্য তার জন্য অনেকগুলো টাকা পাঠিয়েছে, তার এভারেজ খুনের রেটের চেয়ে বেশি। ভয় এবং টাকা দুই কারনেই নজরদারির মত তুচ্ছ এক এক কাজ সে করছে। অবশ্য ভালই হয়েছে, এখন তো বয়স বাড়ছে, রাস্তা থেকে তুলে এনে খুন খারাবির মত কাজ দিনে দিনে কঠিন হয়ে যাচ্ছে, এম্নিতেই গত বছর তার এক সহযোগির ভুলে বুঝতে না পেরে এক এম পির শালাকে খুন করে ফেলেছিল, সেই কেইস এখনো তাদের মাথার উপর ঝুলছে। এইজন্য গত এক বছরে খুব একটা ব্যাবসা করতে পারেনি তার গ্রুপের ছেলেরা। টাকা পয়সার টানাটানি যাচ্ছে এম্নিতেই। দুই একটা কেইস খেলে এম্নিতেই পানির মত পয়সা বেড়িয়ে যায়। সে একটা সিগারেট ধরিয়ে অপেক্ষা করছে। হলুদ কালারের একটা শাড়ী পড়ে বাড়ীটা থেকে বেরিয়ে আসছে পূলক সেনের মেয়ে জয়া। আহারে কী সুন্দর একটা মেয়ে, বুকের ভেতর টা ছলাৎ করে উঠে। সে বাইকে উঠে বসে। মেয়েটা গলির মুখ পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে রিক্সা নেয়। কামাল বুঝেনা, এত টাকা যে মেয়ের বাপের, সে রিক্সায় ঘুরে ক্যান।

সে রিক্সার সাথে নিরাপদ দূরত্ব রেখে বাইক টান দেয়, এইটা খুবই বিরক্তির কাজ তার জন্য, রিক্সার পেছনে কি আর নাইক চালানো যায়!! ধূর। মেয়েটা ইউনিভার্সিটি এলককায় যাচ্ছে। আচ্ছা। ভালই হলো, অনেকদিন কলা ভবনের সামনে থেকে ভেল পুরি খায় না কামাল। পুরির মধ্যে কুচি করে কাটা শসা, টমেটো আর ঘুঘ্নি, সাথে ঝাল আর টকের অদ্ভুত কম্বিনেশান। কামালের কাছে একদম বেহেশতি খাবার মনে হয়। মেয়েটা কলা ভবন ক্রস করে রেজিস্ট্রার বিলিডিং এর দিকে যাচ্ছে। রেজিস্ট্রার বিলডিং এর বাইরে বাইক থামালো কামাল। রেজিস্ট্রার বিল্ডিং এর বাইরে ডাব বিক্রি হচ্ছে। কামাল ভেতরে শাস দেয়া একটা ডাব নিল। আয়েশ করে দুটা টান দিতেই তার ফোন ভাইব্রেট হতে থাকলো। ফোন তুলেই এক অপরিচিত নাম্বারের ফোনের ওপাশ থেকেই সেই কন্ঠস্বর-’ কোথায় তুমি?’
‘আমি তো রেজিস্ট্রার বিল্ডিং এর সামনে’
‘মেয়েটা কই?
‘মেয়েটা ভেতরে ঢুকেছে, আমি বাইরে তাকে পাহারা দিচ্ছি’
‘গাধা, মেয়েটা ভেতরে ঢুকেছে আর তুমি বাইরে কী করছ! তোমাকে না বলেছি এই মেয়েকে কখনোই চোখের আড়াল করা যাবেনা!’
‘এখন কী আমি ঢুকে খুঁজে দেখব?’
‘হ্যাঁ, দ্যাখো, তবে মেয়েটা যেন চোখের আড়াল না হয়ে যায়!!’
কামাল ফোন রেখে ডাব টাতে আরেকটা চুমুক দিয়ে রেজিস্টার বিল্ডিং এর ভেতর ঢুকে যায়, কিন্তু তার কাছে গোলক ধাধার মত লাগে। কিছুতেই সে আর খুঁজে পায়না মেয়েটাকে। দৌড়ে গেটের কাছে আসে, মেয়েটাকে খুজেই পায় না আর। কী করবে ভেবে পায়না। আসে পাশে কিছু চক্কর দিয়ে আবারো ওই বিলডিং এর সামনে দাঁড়ায়। একজন মধ্য বয়ষ্ক লোককে দেখা যাচ্ছে এখন ঐ ফ্ল্যাটের বারান্দায়, সিগারেট খাচ্ছে। উনাদের কোন আত্মীয় হবে হয়ত। সেই নাম্বারে আবার কল ব্যাক করলো মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলেছে এটা জানানোর জন্য। নাহ, নাম্বারটা বন্ধ। এই অপরিচিত ফোনটা একেকবার একেক নাম্বার থেকে আসে, আর কখনোই কল ব্যাক করা যায় না।


জয়া কয়দিন ধরেই বাসায়, শরীর টা ভাল যায় না, প্রেগ্ন্যান্সির নানান ধরনের উপসর্গ তাকে অস্থির করে তুলছে। হাসান, রিনিকে বিয়ে করেছিল এই অসহ্য সত্য টা জয়া একবারের জন্যো মেনে নিতে পারেনা। হাসান শুধুই তার। স্কুলের মাঠে হাসান যখন ক্রিকেট খেলতো, জয়া দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখতো, বেশিরভাগ দিনই সে কাছে যাওয়ার আগেই দেখা যাত এক গাদা বন্ধু আর কান্তা দ্বারা পরিবেষ্টিত হাসান। সে সবসময় হাসানের সব চেয়ে প্রিয় মানুষ হতে চেয়ছে, কিন্তু হাসান কেন যে কান্তার জন্য এত পাগল ছিল আজো হিসাব মেলেনা জয়ার। কান্তা খুবই ঠোঁটকাটা স্বভাবের মেয়ে বরাবরই। হাসান ছাড়া কেউ ই অহংকারি কান্তাকে তার ওমন স্ট্রেট ফরোয়ার্ড স্বভাবের জন্য ভালবাসতও না। হাসানের বাবা মারা যাওয়ার সময় টাতে জয়ার সব চেয়ে অসহ্য লেগেছিল কান্তাকে। অসহায় হাসানের কাছে যেতে চাইতো না কান্তা, তার নাকি হাশিখুশি হাসানের করুন মুখটা সহ্য হয় না। একদিন বন্ধুদের সাথে সিগারেট খেয়েছিল হাসান কৌতুহল বশতঃ[তখনো সিগারেটের নেশা পায় নি হাসান কে, হাসান বরাবর ই যে কোন নেশা বিরোধী] জয়া ইনিয়ে বিনিয়ে কানাতকে ব্যাপারটা জানাতেই কান্তা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে, জয়া তখন আগুনে ঘি ঢেলে দেয় এই কথা বলে যে, ‘জানিস হাসানরা নাকি বাড়ী ভাড়া দিতে পারছেনা’ কান্তার অহংকারি জবাব- ‘সিগারেট তো ঠিকই খেতে পারছে’ জয়া হাল্কা বোঝানোর ট্রাই করেছিল- ‘দ্যাখ হাসান খারাপ একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে’
জয়ার এক কথা- ‘ তার মানে এই না যে সে নষট হয়ে যাবে’
কলেজের টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারেনি বাবা মারা যাওয়ার আর সেইসময়ে মা খুব অসুস্থ ছিল বলে। হাসান খবর টা জানাতে পারেনি কান্তাকে। জয়া হাসানের বাসায় গিয়ে ব্যাপারটা জেনেছিল এবং খুব ভাল বান্ধবীর মত কান্তাকে জানাতে বলেছিল। নানান ধরনের ঝামেলায় জর্জরিত হাসান কিছুটা উষ্মাতেই বলেছি, আমার কী আর প্রেম ভালবাসার সময় আছে?’
জয়ার ও খবর টা কান্তা কে দিতে দেরি হয় নি- জানিয়েছিল কান্তার সাথে সম্পর্ক টাকে নাকি ভোলার চেষটা করছে হাসান। কান্তার মাঝে একটু একটু করে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল হাসান কে ঘিরে। এর মাঝে জয়ার মায়ের কাছ তেক হাসানের মা হাজার দশেক টাকা ধার করেছিল, যদিও সময় অনুযায়ী ফেরত ও দিয়েছিল। জয়া কান্তাকে এই তথ্য দিতেও ভুল করেনি। কী ভেবে জানি জয়া কান্তাকে কিছুটা খোঁচা মেরেই বলেছিল- ‘তোর হাসানের মা তো ইদানীং টাকা ধার নেয়ার জন্য আমাদের বাসায় এসে বসে থাকে, কাল হাসান এসে দশ হাজার টাকার নিল। কে জানে আদৌ দিতে পারবে কিনা!! আমি অবশ্য মা কে বলেছি কতই তো দান দক্ষিণা কর। হাসান্ রা যখন বিপদে সাহায্য না হয় করলে!!’
বলেই কান্তার রক্তম মুখের দিকে তাকিয়ে অলক্ষ্যে হেসেছিল জয়া। পরে অবশ্য জেনেছিল, কান্তা হাসান কে অনেক বার টাকা দিয়ে হেল্প করতে চেয়েছে কিন্তু হাসান নাকি নেয় নি। তখন নাকি হাসান কে বেশ অপমানিত হতেও হয়েছে কান্তার সাথে, এসন কথ হাসানের কাছ থেকেই শোনা হাসানের। জয়া মাঝে মাঝে ভাবে কান্তার কাছ থেকে হাসান কে কি ছিনিয়ে এনেছিল সে!! হলে হব, মুখ টিপে হেসে নিজের মনেই বলে- ‘everything is fair in love and war. কিন্তু হাসান কে কী হারিয়ে ফেলল সে!! কোথায় হারালো তার হাসান, তার একলার হাসান। কান্তার মত উন্নাসীক সুন্দরীর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা তার প্রথম এবং একার পুরুষ হাসান।
রিনির ফোনে সম্বিত ফিরে পেল জয়া। রিনি তাকে কেন ফোন করেছে! আচ্ছা নাছোড়বান্দা তো এই মফস্বলের মেয়ে!। সে যথাসম্ভব হাল্কা গলায় ফোন ধরে বলল- ‘হ্যাঁ রিনি বলো!’
‘জয়া দিদি, আপনি কি জানেন হাসান তো পরীক্ষাই দেয় নি!! তার এটেন্ডেন্স শীটে অন্য কেউ হয়ত সাইন করেছে। তার খাতা খুঁজে পাওয়া যায় নি। এবং সে ফেইল করেছে পরীক্ষায়’;।
‘কী বলছো তুমি!! কিভাবে জানলে’
‘দিদি আজ ওদের রেজাল্ট বেরিয়েছে এবং হাসান এর রেজাল্ট খাতা না পাওয়ার কারনে উইথেল্ড, বাবা মাত্র ভার্সিটি থেকে খবর নিয়ে আসলো!!
জয়ার গলা শুকিয়ে আসছে, তাহলে আবিদ সবাইকে কেন মিথ্যা বলল???
চলবে…

মন্তব্য করুন