নিয়তি – পর্ব ০৭

নিয়তি


গ্রীন আমব্রেলা ইন্সিওরেন্স কোম্পানির জি এম(ক্লেইম সেটেলমেন্ট) সুলতান হোসাইন জয়াকে জানালেন, তার বাবার ৫ কোটি টাকার লাইফ ইন্সুরেন্স ছিল, আর সেটার নমিনি জয়া। তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ক্লেইম এর অর্থ নিজের একাউন্টে নিতে পারবে। শর্তের অন্যতম হলো জয়া এই টাকার ২০% অবশ্যই তার মায়ের একাউন্টে ট্রান্সফার করবে এবং জয়া অবিবাহিত থাকলেই কেবল মাত্র এই টাকা জয়া পাবে। নয়তো সম্পূর্ণ টাকা পূলক সেন ট্রাস্টের মাধ্যমে জনহিতকর কাজে খরচ করা হবে। এই অদ্ভুত শর্ত পূলক সেন নাকি মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেই ইন্সুরেন্সের উইলে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। জয়ার এত অবাক লাগছিল বাবার শর্তে। বিছানা ছেড়ে নামতে গেল জয়া হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিল খাটের পাশে রাখা বুক শেলফ ধরে। জয়ার ঝাঁকুনিতে তাদের সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেট থেকে কেনা বুক শেলফ খুব জোরে ঝাঁকুনি খেল। শেলফের উপর থেকে একটা খাম এসে পড়লো জয়ার সামনে, বেশ ময়লা ধুলোয় ভরা খাম হাতে তুলে নিল জয়া। ভিতরে একটা ফর্ম, কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের সম্মতিপত্র। ‘আশার আলো’ নামে এক প্রতিষ্ঠানে কিডনি ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের জন্য আনা হয়েছে এই ফর্ম। বেশ কয়েক মাস আগে। জয়া অবাক হল, কে এনেছে এই ফর্ম!! হাসানের সাথে তার কখনোই এইসব নিয়ে কোন কথা হয়নি, তবে!! জয়া একটা ছোট টুল এনে শেলফের উপরে চোখ রাখলো, নাহ আর কিছুই নেই। কী ভেবে যেন সে খাম টা ব্যাগে ভরে নিলো। এবার সে রওনা দিল হাসানের মায়ের সাথে দেখা করবে ভেবে।
গোল্ডেন আই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে জয়া ওড়না দিয়ে মুখ মুছল জয়া। তারপর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে হাসানের মায়ের সামনে দাঁড়ালো। হাসানের মা ছোটবেলায় দেখেছেন জয়াকে। কাছে ডেকে নিলেন। জয়া হাসানের মাইয়ের শরীরের খবর নিল। তারপর বলল- “হাসান একটা ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন আন্টি সত্যি, কিন্তু পুলিশ ঐ বাসা অব্জারভেশানে রেখেছে, এখন আপনারা সেই বাসায় উঠলে কিছু ঝামেলা সৃষ্টি হতেই পারে, পুলিশ নাকি এসে চাবি ও নিয়ে গেছে”। ‘আপনি বরং চাইলে আমাদের বাসায় এসে থাকতে পারেন, আমার আর মায়ের ভাল ই লাগবে আপনি থাকলে”
‘নারে, মা এটা হয় না, তুমি বরং চাবি টা দিয়ে যাও হাসানের বাসার”
“আন্টি আপনাকে তো বললাম ই যে পুলিশ ঐ বাসা অবজারভেশানে রেখেছে, ঐ বাসার চাবি আমি আপনাকে দিতে পারছিনা। আর আরেক টা কথা আপনার জানা উচিৎ ঐ বাসা কিন্তু হাসানের একার না। আমারো’।
‘কী, এসব কী বলছ তুমি, আজ আমার ছেলে সামনে নেই বলে যা খুশি বলে যাচ্ছ!!”
হাসানের মায়ের সামনে দাঁড়ানো রিনি তখন বসে পড়লো হাসানের মায়ের পাশে, খাটে।
‘জয়া দিদি, আপনি কী বলছেন, আমি ওর বিবাহিত স্ত্রী,ঐ বাসা আপনার কিভাবে হলো!! আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছিনা’
জয়া এবার শক্ত গলায় জানালো- প্রথম কথা হচ্ছে, হাসানের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেক বেশি পুরানো আর গভীর। হাসান কেন সেটা আপনাদের জানায়নি সেটা আমি বুঝতে পারছিনা। সম্ভবতঃ আপনারা তাকে ব্ল্যাক মেইল করে বিয়ে করতে বাধ্য করেছেন বা এমন কিছু!
‘চুপ করো মেয়ে তুমি!”
এবার অপ্রকৃতিস্থের মত হেসে উঠল জয়া-‘ আপনারা ভ্রমের রাজ্যে আছেন, আমার গর্ভে হাসানের সন্তান। আপনার চাইলে ডি এন এ টেস্ট করাতে পারেন’ ‘আপনাদের ভোলাভালা হাসান আর আমার বিয়ে হয়েছে আরো ৩ বছর আগে”।
এবার কেদে উঠল রিনি। রিনির ফুপিয়ে কেঁদে ওঠার শব্দে হচকিত অবস্থা থেকে সম্বিত পাওয়ার আগেই জয়া হাসানের মা কে প্রণাম করে বলল-‘ মা, আপনার ছেলে না থাকলেও আপনার দায়িত্ব আমি খুব ভাল্ভাবেই সামলাতে পারব, অন্যের আশ্রয়ে না থেকে আপনার ছেলের বউয়ের কাছে চলে আসবেন আশা করি’।
‘ও, হ্যাঁ, আর রিনির সাথে বিয়ের ব্যাপার নিয়ে বেশি জল ঘোলা করলে আমি থানা পুলিশ করতে বাধ্য হব, জানেন ই তো যে স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে অপরাধ’
বলে ক্রুর হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলো জয়া।
হোটেল থেকে বেরিয়ে তার আর হাসানের প্রিয় রেস্টুরেন্ট ‘ENIGMA’ তে বসলো। খুব অদ্ভুত এই রেস্টুরেণ্ট প্রতিটা খাবারের নাম একেক্টা ধাঁধাঁ যেন। নরমাল চিকেন ফ্রাই লিখবে না এরা লিখবে Curry/ Fry of that, what is common to eat before it’s born and after it’s dead?
জয়ার এসব জিনিস খুব ই বিরক্ত লাগতো মাঝে মাঝে, কিন্তু হাসানের এই রেস্টুরেন্টের রিডল সল্ভিং ব্যাপারটা খুব ভাল লাগতো। একবার দোকানের মালিককে হাসান তাক লাগয়ে দিয়েছিল একটা কোডিং জিজ্ঞেস করে। হাসানের হেয়ালি মনে করে খুব হাসল জয়া। কী ভেবে যেন নূপুর টা বের করলো সে, খাবার আসার ফাঁকে সে টেবিলের উপরে রাখা টিস্যুর মধ্যে কলম দিয়ে অক্ষরগুলা আবার লিখলো। Y-B-I-F-B-S-B-L-K-J-B-3
জয়া ভাবতে লাগলো Y এর আগের বর্ন যদি হয় X, B এর A, I এর H এমন করলে পুরো কথাটা দাঁড়ায়- XAHEARAK শেষে আবার থ্রি। নাহ কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না জয়ার। আজ লাঞ্চে দেরি হয়ে গেলো জয়ার, খুব টায়ার্ড লাগছে। সে তবুও মাকে কিছু জানানোর আগেই সে ইন্সুরেন্সের অফিসে একবার ঢুঁ মারার সিধান্ত নিল। আজ সারাদিন সে বাসার গাড়ী টা নিয়ে এসেছিল, এখন ড্রাইভার কে বিদায় দিয়ে একটা রিক্সা ডাকলো।
হাসান আর জয়ার বিয়ের খবরে রিনি খুবই মুষড়ে পড়েছে। সে ভাবতেই পারছেনা, হাসান জয়াকে বিয়ে করেছে। আজ জয়ার কথায় বুঝলো তার পায়ের নিচে আসলেই মাটি নেই। এদিকে তার ফুপু মানে হাসানের আম্মা আরো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রিনি জানে হাসানের সাথে জয়ার বিয়ের খবর বাবাকে জানালে তার বাবা হৈ চৈ করে তুলকালাম কান্ড বাঁধাবে। এমন ও হতে পারে সে হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। খুব দ্রুত সিধান্ত নিল সে, ‘ফুপু, হাসানের সাথে জয়া দিদির বিয়ের কওন কথা বাবাকে বলার দরকার নাই, প্লিজ। আমরা হাসান ভাই ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো’, আর হ্যাঁ এতদিন আমি চুপ করে বসে ছিলাম ঠিকই এবার আমি হাসান ভাইয়ে খোঁজার চেষ্টা অবশ্যই নিজের মত করে করব। আমার ধারনা এই জয়া দিদি হাসান ভাইয়ের খবর জানে’, আপনি শুধু কথা দেন বাবা কে কিছু বলবেন না।‘ বলে শক্ত করে হাত চেপে ধরলো ফুপু। দু’ফোটা চোখের জল ফেলে মাথা ঝাকালেন হাসানের মা।
জয়া ইন্সুরেন্স কোম্পানির জি এম এর অফিসে বসে আছে। অত্যন্ত ধুরন্ধর দেখতে এই জি এম সুলতান সহজে তার হাত গলিয়ে ক্লেইম পাওয়া অসম্ভব, কিন্তু তার সামনে বসে আছে জয়া সেন- সদ্য খুন হওয়া জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক পূলক সেনের মেয়ে। কেইস টা খুব ই সেনসিটইভ। উপরের লেভেল থেকে চাপ আসবে একটু কিছু হলেই। এমনকি মন্ত্রীদের অনেকেরই বন্ধু ছিলেন পূলক সেন। এমন জাদরেল একজন ব্যাক্তিত্বের মানুষের মেয়ে এমন সাদামাটা ভাবতেই তার কিছুটা অবাক লাগলো। হ্যাঁ, জয়া মোটামুটি সুন্দরী। উজ্জ্বল শ্যামলা, গড়পড়তা বাঙ্গালী মেয়ের মাঝে তাকে আলাদা করে চোখে পড়বেনা। মাঝারি গড়নের হাইট। লম্বা চুল। তবে হ্যাঁ, এইকথা বলতেই হবে তার চোখ গুলো বেশ সুন্দর। জয়া বেশ জোর দিয়ে কথা বলে, যা তার ব্যাক্তিত্ত্বকে কিছুটা কঠিন করেছে বলে ভাবলেন সুলতান সাহেব। স্মিত হেসে বললেন- ‘মিস সেন, আসলে পূলক সাহেবের ব্যাপারে আমাদের খুব বেশি কোয়ারি নেই, আপনি আপনার ন্যাশনাল আইডি কার্ড, ডেথ সার্টিফিকেট আর আপনার পরিবার থেকে আপনি যে বিবাহিত নন সে মর্মে একটা এন ও সি ধরনের কাগজ লাগবে, যেটা আপনার মা দিলেও হবে’।
‘ঠিক আছে, আমি কালকের মাঝেই পেপার ওয়ার্কগুলো সেরে ফেলব, কিন্তু আমাকে একটু বলবেন কি, টাকাটা আমার একাউন্টে আসতে আসলে কয়দিন লাগবে, বাবার কিছু লায়াবেলিটিস আর ঋন ছিল সেগুলো আমি দ্রুতই শোধ করতে চাই’ আন্দাজে ঢিল ছুড়লো জয়া।
‘ আমাদের ম্যাক্সিমাম সেটেল্মেন্ট টাইম ১ মাস, তার উপর উনার এমাউন্ট টাও বেশ বেশি, আমার মনে হয় এক মাসের মাঝেই আপনারা টাকাটা পেয়ে যাবেন’
‘মেইক ইট ফিফটিন ওয়ার্কিং ডেইজ মিঃ সুলতান, আশা করছি আমাকে কাউকে দিয়ে ফোন দেয়াতে হবে না। এনিওয়ে জামিল কাকু কী অফিসে আছেন!!’
জামিল এমদাদ, গ্রীন আম্ব্রেলা ইন্সুরেন্সের এম ডি, নাম টা রুমে ঢোকার আগেই জয়া খেয়াল করেছে, কিন্তু আসলে তার সাথে ব্যাক্তিগত কোন পরিচয় তার বাবার ছিল কিনা তা সে জানেনা। তবে একটা জিনিস বুঝেছে এই মুহুর্তে কাজ বাগাতে হলে এতটুকু গেইসগেম তাকে খেলতেই হবে। জামিল এমদাদের নাম শুনেই গলা শুকিয়ে গেলো সুলতান সাহেবের, জামিল এমদাদ খুব ই বদমেজাজী ধরনের লোক আর একদমই উটকো ঝামেলা পছন্দ করেন না, এখন পূলক সেনের মেয়ে গিয়ে যদি তার নামে উলটাপালটা কিছু বলে তবে তার হয়ত চাকরি নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে। জিহবা দিয়ে ঠোট চেটে সুলতান সাহেব বলল- ‘স্যার সম্ভবত অফিসে নেই, আমি ১৫ দিনের মাঝে টাকা আপনার একাউন্টে ট্রানফারের ব্যাবস্থা করব। ‘
‘ থ্যাংক ইউ সুলতান সাহেব, আপনি স্মার্ট, আমি আপনাকে মনে রাখব’ বলে উঠে দাঁড়ালো সে।
সুলতান সাহেব বেশ বিগলিত হাসি দিয়ে উঠে গিয়ে রুমের দরজার খুলে সাহায্য করলো জয়াকে।
জয়া এখান থেকে সোজা চলে গেল বাসায়, ভীষন টায়ার্ড লাগছে তার।
রিনি ফুপুকে নিষেধ করে বেশ একটু রিল্যাক্স বোধ করছে। এবার সে ভেবে রেখেছে হাসানের ভার্সিটি বন্ধুদের খোঁজ করবে। ফুপুর কাছ থেকে হাসানের বন্ধু আবিদ আর ফাইয়াজের নাম্বার নিল সে। স্ত্রীর পরিচয় গোপন করে সে কাজিনের পরিচয়ে ফোন করলো আবিদ কে। আবিদ পরীক্ষা হলের ঘটনা যা সে জয়াকেও বলেছিল, পুলিশকেও বলেছে তা-ই বললো। জয়া আবিদের কাছে জিজ্ঞেস করছিল হাসানের শার্টের রঙ, প্যান্টের কালার। আবিদ বলল।
এবার সে ফোন করলো ফাইয়াজ কে। ফাইয়াজ, হাসানের নিখোঁজ হবার পর থেকে ক্যাম্পাসে আসেনা খুব একটু। সে একটু ভীতু কিসিমের। তাই এসব ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। তবু পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ এ তার নাম ও ছিল। রিনির কাছে সে ও আবিদের মত ই ঘটনার বর্ননা করলো। রিনি চুপ করে শুনলো। এবার জানতে চাইলো ঘটনার দিনে হাসানের পড়া শার্ট প্যান্টেড় কালার। ফাইয়াজের উত্তরে রিনি ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এবার সে বুঝলো তার খটকা তাহলে ঠিক ই আছে। ফাইয়াজ জানালো নীল চেক শার্ট এর সাথে নীল ডেনিম পড়ে এসেছিল হাসান পরীক্ষা হলে। আর আবিদ বলেছিল লাল পলো শার্ট সাথে স্কাই ব্লু ডেনিমের কথা।
চলবে…………………………।।

মন্তব্য করুন