নিয়তি – পর্বঃ০৬

নিয়তি

জয়ার মা সব শুনেও কেন জানি খুব সাহসী আচরণ শুরু করলেন, জয়াকে দ্রুত ডাক্তারের চেক আপে মাঝে রাখলেন, নিজের সমস্ত লিংক ব্যাবহার করে হাসানের খোঁজ করার জন্য পুলিশের উপর মহলের সাথে যোগাযোগের ব্যাবস্থা করলেন। এদিকে জয়া সিদ্ধান্ত নিল হাসানের মায়ের সাথে দেখা করবে, সম্ভব হলে তাকে সব কিছু খুলে বলবে। হাসানের মায়ের কাছে যাবার আগে কী ভেবে যেন সে হাসানের বাসায় যায় আবার। কেন যেন বাসায় ঢোকার আগে খুব ভয় লাগছিল, অথচ এই বাসাটা তার নিজের হাতে গোছানো, আলমারির তাকে তার কাপড়। এমন কি বেসিনের উপর তার ব্যাবহৃত টুথ ব্রাশ সবই যেন নিরব সাক্ষী দিচ্ছে তার আর হাসানের সুখময় দাম্পত্যের। রিনি কে হাসান বিয়ে করেছে, এটা জয়া একেবারেই মানতে পারছেনা, জয়ার ধারনা হাসানকে গভীর কোন ষড়যন্ত্রে ফেলা হয়েছে, সেটা কী জয়াকে খুঁজে বের করতেই হবে!! কিন্তু কিভাবে কোন আইডিয়া করতে পারেনা সে। অনেকদিন আগের পড়া প্রিয় এক থ্রিলারের কথা মনে পড়ল- যখন তুমি কানা গলিতে আটকে যাবে, থাম! ভাবো ঠিক কিভাবে কিভাবে তুমি কানা গলিতে এলে, অবশ্যই কোন পথ ফেলে এসেই কানা গলিতে আটকে গেছ। যদি একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে বের করতে পারো কানাগলিতে ঢোকার পথ টা কোথায় ছিল, তাহলে অবশ্যই তুমি সঠিক পথে যাবার বা এখান থেকে বের হবার পথ পাবে’’।

জয়া ভাবলো, একটা দিন সে এই বাসায় কাটাবে, নিজেকে কিছুক্ষন সময় দেয়া দরকার।

হাসানের ফ্ল্যাটের একটা এক্সট্রা চাবি সবসময় থাকে বাড়িওয়ালার কাছে। জয়া আজ বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে শুনলো পুলিশ নাকি এক্সট্রা চাবি টা নিয়ে গেছে, কথাটা শুনলে ভ্রু কুচকালো জয়া। ভাবলো, ডি আই জি আংকেলের কাছ থেকে জানতে হবে ব্যাপারটা। সে ছাদে উঠে, কী ভেবে যেন ছাদের দরজা টা বন্ধ করে দিল। আজকের দিন টা সে শুধুই একা কাটাবে, দুপুরে ফুড পান্ডায় কিছু অর্ডার করে নিবে। গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো জয়া। কি সুন্দর ছিমছাম তাদের ঘর, চোখের কোনায় মুক্তো বিন্দুর মত টলটল করছে জল তার, সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। তার কপালের কয়েকটা অব্যবহৃত টিপ এখনো আয়নায় আটকে আছে। আহা! কত সুখস্মৃতি তার এই আয়নার সামনে, হাসানের একটা অভ্যাস ছিল, জয়া আয়নার সামনে দাঁড়ালেই, পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরবে। হাসানের কথা ইদানিং ভাবলেই অসহ্য কষ্ট হয় জয়ার। কোথায় কেমন আছে কে জানে!! খেতে ভীষন ভালবাসতও তার হাসান, আর কত হাসিখুশি মানুষ টা। ছোটবেলা থেকে সে হাসানকে ছাড়া কিছুই ভাবেনি, দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা কাগজ কলম নিয়ে বসলো জয়া বিছানায়। পুরো জিনিসটা প্রথম থেকে ভাবা শুরু করলো সে- ‘হাসান আর সে ছোটবেলার বন্ধু, হাসানের স্কুল জীবনের প্রেম ছিল কান্তার সাথে, কান্তার সাথে ব্রেক আপের পর হাসানের সাথে তার সম্পর্ক যেটা প্রেম থেকে দাম্পত্যে গড়ায় গত ২ বছর আগে, হাসানের কোন সিক্রেট বিষয় ই ছিল না যে জয়া জানেনি, এমন কি হাসান কখনোই তাকে মিথ্যা বলেনি। হাসানের বন্ধুরা অনেকেই  তাকে ভাবি ডাকে, হাসান সবসময় ই তাকে সবার কাছে নিজের স্ত্রী হিসাবে পরিচয় দিয়ে এসেছে, এমনকি পরীক্ষার পর হাসানের মায়ের কাছেও ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার কথা। হাসানের মা কয়েকমাস আগে খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল, ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তিও ছিল কিন্তু হাসান একবারো তাদের বাসায় মাকে আনার কথা বলেনি, তার মানে সে চায় নি মা এই বাসায় আসুক। যদি সে চাইতো অবশ্যই মাকে এই বাসায় নিয়ে আসতে পারতো। সেই সময় টা হাসানের অনেক টাকার দরকার ছিল, জয়া বাবার কাছে হাসানের জন্য কিছু টাকা ধার ও চেয়েছে, বাবা কঠিন গলায় না করে দিয়েছিল। হাসান অনেক কষ্টে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে সামান্য টাকা যোগাড় করেছিল, বাকি টাকা তার মামা দিয়েছে বলে শুনেছে। হাসানের নিখোঁজ হবার দুইদিন আগেও জয়া সারাদিন ওর কাছে ছিল, পরীক্ষার পড়ার সময় টাতে ওর আরো দুইদিনের রান্না করে দিয়েছিল জয়া। ফ্রিজ খুললে এখনো হয়ত সেই তরকারির অবশিষ্ট পাওয়া যাবে। ফ্রীজের খাবার নষ্ট হয়ে মনে হয় পচে গলে যাচ্ছে, ভেবে বিছানা থেকে নেমে ফ্রীজ খুললো জয়া। ফ্রীজের ভেতর বরফ জমে আছে। কোন খাবারে বক্স চোখে পড়লো না, তাহলে কি হাসানে সব খাবার খেয়ে শেষ করেছিল!! ফ্রীজের ভেতরের দিকে একটা প্যাকেটে কিছু দেখা যাচ্ছে, সসেজ টাইপ। জয়া ভাবলো পচে যাচ্ছে ফেলে দিবে, প্যাকেট টা টান দিতে ভয়ে জমে গেল জয়া!! হাতের আঙ্গুল!! প্যাকেটের উপরে মার্কার দিয়ে একটা কিছু একটা লেখা, MRILH-2058.

জয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, মাথাও ঘুরাচ্ছে, কিচ্ছু বুঝতে পারছেনা সে। মে মাসের সাত তারিখে হাসান নিখোঁজ হয়, তার আগে ৫ তারিখে সে লাস্ট এই ফ্রীজ খুলেছে, ৪ টা আলাদ বক্সে ৩ দিনের খাবার রেখেছিল।  প্রতি বক্সে সকালের নাশতা বাদে প্রতি বেলার খাবার রাখা ছিল, সে হিসাবে মাত্র দুই বক্স খাবার শেষ হবার কথা, আরো দুই বক্স তরকারি থাকার কথা। ৫ তারিখ এর রাতের খাবার বাইরে বের করে রেখে সে গিয়েছিল বাসায়। তার মানে হাসানের নিখোঁজ হবার পর ও কেউ একজন এই বাড়ীতে এসেছে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে, এমন কেউ যার কাছে বাসার চাবি আছে। এবং সে তাকে এবং হাসান কে বিপদে ফেলার জন্য কোন ভয়ঙ্গকর পরিকলপনা করেছে। অথবা ? না সেই সম্ভাবনা ভুলেও মাথায় আনতে চায় না জয়া। তার হাসান অবশ্যই কোন ক্রাইমের সাথে যুক্ত হতে পারেনা। জয়ার প্রচন্ড তৃষ্ণা পাচ্ছে, সে ব্যাগের ভেতর থেকে বোতল বের করতে গেল, বোতলের সাথে জড়িয়ে এলো একজোড়া নূপুর, নূপুর জোড়া দেখে কান্না পেলো জয়ার, ওর গত জন্মদিনে দেয়া হাসানের উপহার। রুপার নুপুরের গায়ে কিছু অক্ষর, এলোমেলো অক্ষর। হাসান বলেছিল, এখানে একটা কোড আছে জয়াকে ডিকোড করতে হবে। যদি পারে তবে জয়াকে একটা সিক্রেট জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে। জয়া তখন পারেনি। হাসান কে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল হাসান শুধু হেসেছে, বলেছিল- জয়া অবশ্যই পারবে। যেদিন পারবে সেদিন সে হাসান জানবে হাসানকে বুঝে নিবে জয়া। অক্ষর গুলো ছিল- YBIFBSBLKJB3”.  জয়া হাসানের এইসব ছেলে মানুষির সাথে ছোটবেলা থেকেই তাই আর মাথা ঘামায় নাই, হাসান খুব ভালবাসতো রিডল, কোডিং। একবার তো ড্যান ব্রাউনের ভিঞ্চি কোড পড়ে ক্রিপ্টেক্স আর অন্যান্য অন্যান্য সব কোডিং, ডিকোডিং নিয়ে রাত দিন পড়ে থাকতো। বন্ধুদের জন্মদিনে নানারকম রিডল দিয়ে মজা দিত। একবারে ওদের এক বন্ধু আবিদের জন্মদিনে আবিদকে একটা  রিডল দিয়েছিল, তিনটা বক্স দিয়েছিল সে আবিদকে যার মধ্যে যে কোন একটা বক্সে আবিদের গিফট টা আছে, হাসানের রিডল টা সল্ভ করলে আবিদ গিফট টা পাবে, নয়ত আবিদ সবাইকে ট্রিট দিবে। তিনটা বক্স তিনটা আলাদা রঙের গিফট র‍্যাপে মোড়া ছিল একটা ছিল লাল র‍্যাপে মোড়া, একটা ছিল নীল র‍্যাপে মোড়া আরেক টা ছিল হলুদ র‍্যাপে মোড়া। হাসান আবিদ কে তিনটা ক্লু দিয়েছিল যেখান থেকে সঠিক উত্তর টা খুঁজে বের করতে হবে, প্রথম ক্লু ছিল- গিফট টা লাল বক্সে আছে, দ্বিতীয় ক্লু হচ্ছে- নীল র‍্যাপের বক্সে গিফট টা নেই, তৃতীয় ক্লু টা লেখা ছিল হলুদ বক্সে- গিফট টা আছে লাল বক্সে। হাসান বলেছিল এই তিনটা ক্লু এর মধ্যে যে কোন একটা সত্য, বাকি গুলা মিথ্যা। আবিদ কে সত্য টা খুঁজে বের করে গিফট টা নিতে হবে। আবিদ আর হাসানের এই ক্লু নিয়ে সে কী খুনসুটি। মনে পড়েই নিজের অজান্তেই হেসে উঠলো জয়া। কিছুক্ষন আগের ফ্রিজের মাঝে পাওয়া ফ্রোজেন আঙ্গুলের কথা কিছুক্ষনের জন্য ভুলে গেলো সে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই কেমন যেন চোখ বুজে আসলো জয়ার।

ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখছিল জয়া, এক অতলান্তিক কুয়ায় পড়ে যাচ্ছে জয়া, কী ঘুটঘুটে অন্ধকার, আর কেমন শেওলা ধরা গন্ধ, ঘুমের মাঝেই যেন গন্ধ পাচ্ছিল, এর মাঝেই টের পেল তার সাথে বাঁধা তার সন্তার চিৎকার করছে আর ক্রমাগত লাথি দিচ্ছে তাকে, অসহ্য পরিস্থিতি এর মাঝে সে হঠাৎ দেখতে পেল কেউ একজন চিৎকার করে নাম ধরে ডাকছে জয়া জয়া জয়া, কন্ঠ টা পরিচিত সে মনে করতে পারলো না। জয়ার ঘুম ভাংলো ওবাইল ফোনের ভাইব্রেশানে। ফোন বাজছে তার। আর ফোনের রিঙটোনে মায়ের গলায় তার নাম সেইভ করা সেটাই ঘুমের ঘোরে শুনছিল সে। কোন একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। জয়া ক্লান্ত গলায় ফোন টা রিসিভ করে রীতিমতো ভিড়মি খেলো। আপনা আপনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো- কী!! সত্যি!!

মন্তব্য করুন