
রিনি খুব দুখী একটা মেয়ে, রিনি জন্মাবার সময় ওর মা মারা গেছেন, সে বড় হয়েছে বাবার কাছে। রিনি বাবা তালিব সাহেব খুব বদ রাগী মানুষ, যদিও রিনি ধারনা উনার সবটাই ভান কেবল মাত্র রিনিকে ঠিক মতো মানুষ করার জন্য। রিনি জানে তার বাবা রিনির কোন অনুরোধ কখনো ফেলে না, কিন্তু এমন ভাব করবে যেন সে বাবাকে খুব ই বিরক্ত করছে। রিনির খুব ইচ্ছা ছিল ঢাকায় পড়তে যাবার, বাবার কারনে যাওয়া হয়নি। ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন বাবার আকাশ পাতাল জ্বর, রিনির ধারনা সে ঢাকায় পড়তে যাবে ভেবেই বাবা এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার ফুপু অবশ্য বলেছিল তাকে পরীক্ষা দিতে ঢাকায় যেতে কিন্তু তার আর ইচ্ছা করেনি। অবশ্য ওতো লেখাপড়া তার ভাল ও লাগেনা, সে ঢাকা যেতে চেয়েছিল হাসানের জন্য। হাসান তার ফুপাতো ভাই, সবসময় বড় ভাই সুলভ একটা এটিচিউড করলেও কিছুক্ষনের মধ্যেই মজার মজার গল্পে সব মাতিয়ে রাখে। হাসানের এই হাসিখুশি মাতিয়ে রাখার ব্যাপারটা রিনির ছোটবেলা থেকেই খুব ভাল লাগত, একটু বড় হবার পর সে হঠাত আবিষ্কার করলো, হাসান কয়েকদিন দেরি করে বাড়ীতে আসলেই তার বুকের ভেতর অসহ্য কষ্ট হয়। তার এস এস সি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন হাসান ঢাকা থেকে আসেনি বলে সে সারারাত কাঁদল। হাসান বাড়িতে থাকলে রিনির কাজ ছিল কারনে অকারনে হাসানের আশেপাশে ঘুরঘুর করা, হাসান রিনিকে ছোটখাটো উপহার যাই- দিত রিনি খুব যত্ন করে তুলে রাখতো। রিনির বাবা রিনিকে খুব ভালই বুঝতো বলা যায়, নয়তো সে তার বোন কে মোটামুটি ইমোশোনাল ব্ল্যাক্মেইলিং করে রিনির সাথে হাসানের বিয়ের ব্যাপারে রাজি করাতো না। হাসান কে রিনির বাবার কোনকালেই পছন্দ না, হাসানের মত কনিফিউজড মানুষকে তার মতো জাদরেল রাজনীতিবিদের ভাল না লাগাই স্বাভাবিক, কিন্তু হাসান ও কেন জানিনা ওর মামা কে খুব ভয় পায়, ছোট থেকেই হাসান মামা কে দেখলে কেমন যেন চোরের মত পালিয়ে যায়।
মাস তিনেক আগের কথা, যখন হাসানের মায়ের হার্টের সমস্যা টা ধরা পড়ে, হাসান পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল প্রায়, অসুস্থ অবস্থায় হাসানের মা হাসানকে রিনির সাথে বিয়ের কথা বলে, হাসান কিছুতেই রাজি হয় না, এদিকে হাসানের মায়ের চিকিৎসা ব্যয় ও প্রচুর। রিং পরাতে হবে। হাসানের জন্য এক মাত্র অপশান ছিল ওর মামার কাছ থেকে টাকা নেয়া, কিন্তু এক্ষেত্রে রিনির ইস্যু টা সামনে দাড়িয়ে যাচ্ছে, মামা নিশ্চয়ই আর সেক্ষেত্রে টাকা দিবেন না। হাসান ঠিক করেছিল রিনিকে বলবে জয়ার কথা, তারপর খুব রিকোয়েস্ট করবে মামার কাছ থেকে টাকা ধারের ব্যাবস্থা করার জন্য কিন্তু যে দিন রিনির সাথে কথা বলার কথা সেদিনই মায়ের একটা কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে যায় ইন্সট্যান্ট চিকিৎসার ব্যাবস্থা করে মামা। টাকা ধার নিয়ে যখন হাসান প্রায় পাগল, মামা হেসে বলেন- ‘আরে এত অস্থির হচ্ছিস ক্যান, আমার যা আছে তা তো রিনির ই আর তোর মা সুস্থ হয়ে উঠলেই তো তোদের বিয়েটা হয়ে যাবে, তখন রিনির সাথে সাথে আমার সব কিছু তোর ও, চিন্তা করিস না’। হাসান দূর্বল গলায় শুধু বললো- ‘আমি টাকাটা আপনাকে ফেরত দিব মামা, অবশ্যই ফেরত দিব।‘
‘সে দেখা যাবে’ বলে মামা হেসে ওর পিঠ চাপড়ে দিল।
রিনির এখনো হাসানের সাথে বিয়ের দিন টি মনে পড়ে, হাসানের মা সুস্থ হয়ে যেদিন বাসায় ফিরলেন সেদিন ই বাবা আর দেরি করতে চাইলেন না, হাসান কিছু বুঝে উঠার আগেই হাসানের মা দুচোখের অশ্রুতে হাসান কে বারেবার মনে করিয়ে দিতে থাকলেন পিতৃহীন আশ্রয়হীন হাসানকে নিয়ে মামার আশ্রয়ে কিভাবে দিনযাপন করেছেন তিনি, ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতার দাম তার আজ চুকানোর সুযোগ এসেছে, হাসানের না বলার কোন সুযোগ ই নেই। হাসান বারেবার একটি কথাই বলতে চাইল- ‘ রিনিকে সে সবসময় বোনের চোখে দেখে এসেছে’। হাসানের দূর্বল আপত্তি, রিনির বাবার প্রবল ব্যাক্তিত্বের সামনে টিকতেই পারলোনা। চোখ মুখ শক্ত করে হাসান রিনিকে বিয়ে করে ফেলল। রিনির মনে হচ্ছিল আজ তার জীবনের সব চেয়ে আনন্দের দিন। তার সব চেয়ে প্রিয় স্বপ্ন এভাবে পূরন হয়ে যাবে সে ভাবেনি। কিন্তু হঠাত ই একটা জরুরি ফোন আসে হাসানের কাছে, পরদিন ই জরুরি একটা ইনকোর্স, তাকে সে রাতেই ঢাকা ফিরতে হবে। ফিরে যায় হাসান। সে-ই শেষ হাসানের সাথে তার দেখা, ঢাকায় এসে হাসান তার পরীক্ষা, টিউশানি পার্ট টাইম জব নিয়ে অনেক অনেক ব্যাস্ত হয়ে যায়। সে ফোন করলেও ঠিকমতো কথা বলতে পারতোনা। এমনকি এতই আনরোমান্টিক এই হাসান, আজ পর্যন্ত তার কোন ম্যাসেজের উত্তর ও ঠিক মতো দিত না, শুধুই হু হ্যাঁ। হাসানের পরীক্ষা শেষ হলেই অনুষ্ঠান করার কথা ছিল তাদের বিয়ের। কিন্তু এর মাঝে হাসান উধাও হয়ে গেলো। হাসানের উধাও হবার পর থেকে একটা রাত ও তার ঠিক মতো ঘুম হয় নি, বাবা বুঝতো তার মনের অবস্থা, আর তাই তার সম্ভব সব জায়গায় ই সে চেষ্টা করছে হাসান কে খোঁজার। হাসানের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া হাসানের মা আরো অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা জরুরি হয়ে পড়ে, তারা যখন ঢাকায় আসার প্রিপারেশান নিচ্ছিল, তখনই কেউ একজন ফোন করে জানায় হাসান ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থাকে আর যে বাসার চাবি আছে হাসানের বন্ধু জয়ার কাছে, রিনি আজ জয়ার কাছে এসেছিল চাবি নিতে। এত টেনশানের মাঝেও হাসানের বাসা ভাড়া নেবার কথায় মনে মনে একধরনের আনন্দিত হয়েছিল সে, তাহলে হাসান তাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য এতদিন চুপ করে ছিল!! ঠিক ই বাসা গুছাচ্ছে তার জন্য। কিন্তু হাসান আর তার বিয়ের কথা শুনে জয়া কেন অজ্ঞান হয়ে গেলো বুঝতে পারলো না রিনি। শুধুই চিৎকার করে সাহায্য চাইল কারো।
জয়ার জ্ঞান ফিরলো তার মায়ের বজ্র্য কঠিন চেহারা দেখে। হাসপাতালের ডাক্তার জয়ার মা মায়া সেন কে জানিয়েছেন জয়া প্রাগন্যান্ট, স্বামীর শোকের চেয়ে মেয়ের এই ভয়াবহ বিপদ তাকে অনেক বেশি চিন্তায় ফেলেছে। মায়ার ধারনাই ছিল না জয়া এমন ভয়াবহ বিপদে তাকে ফেলবে। জয়া দেখলো তার পাশে আরেকটা উৎসুক মুখ- রিনি। রিনি এসে হাত ধরলো জয়ার-‘দিদি, কেমন লাগছে?’ জয়ার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মুখ থেকে-‘বেঁচে আছি, এটাই তো এখন অসহনীয় লাগছে’। জয়ার মা, জয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-‘তুই আমাকে কিছুই জানাস নি কেন? আমি কিছুই জিজ্ঞেস করবো না, তুই সত্য কথা গুলো আমাকে বলবি’
জয়া রিনির সামনে কি বলবে ভেবে পেল না, রিনির সাথে আসলেই কী হাসানের বিয়ে হয়েছে? হাসান কী তাহলে তার সাথে বেইমানী করেছে!! জয়ার আবারো গা গোলাচ্ছে। জয়া নিজের মনেই বলে উঠলো তার হাসান কোনদিন ও এমন করতে পারেনা, নিশ্চয়ই কোন একটা গোলমেলে ব্যাপার আছে। জয়া রিনি কে বলল- তুমি বলছিলে, আন্টি মানে হাসানের মা অসুস্থ, তাহলে বরং তুমি উনার কাছে যাও আমি সুস্থ বোধ করলে কাল সকালে উনার হোটেলে গিয়ে চাবিটা দিয়ে আসব কিংবা কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিব। রিনি আর কথা বাড়ালো না। হেঁটে বেরিয়ে গেলো।
এবার জয়া উঠে বসে মা কে কাছে ডাকল। মা আমার কাছে তুমি একটু এসে বসো প্লিজ, আমি এমন কিছুই করিনি যাতে তোমাদের বিন্দুমাত্র অসম্মান হয়, মায়া সেন অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নারী, সারাজীবন শিক্ষকতা করেছেন বলেই হয়তো, গাম্ভীর্জ বজায় রাখতে চান সবসময়। মেয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। ‘মা আমি আর হাসান বিয়ে করেছি গোপনে, বাবা জানতে পারলে মেনে নিবেন না ভেবেই আমি গোপন রেখেছিলাম সব কিছু। তোমাকে বলতেও ভয় পাচ্ছিলাম- আই এম সরি মা’ বলেই জয়া মা-কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো, মায়া সেন ও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। জগতের অনেক অনেক আয়রণির মতো, আজ দু’জন ভিন্ন বয়স ও প্রেক্ষাপটের নারী তাদের প্রিয় পুরুষ কে হারিয়ে যেন একে অপরের কাছে অসহায়ত্ব বিনিময় করছে, আজ তারা শুধু কেবল মাত্র শোকে মুহ্যমান নারী, আর কোন পরিচয় ই তাদের যেন আর স্পর্শ করছেনা।