
মানুষ আসলে তার নিয়তির হাতের পুতুল মাত্র। যা ভাবে, যা চায় ঘটে তারচেয়ে ও চমকপ্রদ ঘটনা, আর তাই, জয়া সে সন্ধ্যায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল হাসানের মাঝে, হঠাৎ লোডশেডিং আর হাসানের গায়ে জ্বরের উত্তাপ তাকে কখন যে নিজেকে অনেক অনেক বেশি উদারতায় গ্রহন করতে উদ্ভুদ্ধ করলো হাসানকে। হাসান ও জ্বরের ঘোরে আর বিভ্রমেই কিছুটা জয়ার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। জয়ার ক্ষেত্রে সেটা ছিল পূজার নৈবদ্য আর হাসানের জন্য হয়তো কান্তাকে ভোলার চেষ্টা বা বিভ্রম ছিল, তা জানা যাবে ঘটনা পরিক্রমায় পরে।
হাসান আর জয়া যখন নিজেদের সম্বিত ফিরে পেল, জয়ার চোখে তখন অশ্রু, হাসান দ্বিধায় মুখ ফসকে বলে ফেলল “সরি”
“সরি, মানে! তুই যা করেছিস তা ভুল করে করেছিস, এবং তাতে ভালবাসা ছিল না??” রাগী গলায় জিজ্ঞেস করে জয়া।
সত্যিটা বলতে পারেনা হাসান যে জ্বরের ঘোরে, আলো আধাঁরিতে জয়াকে কান্তা ভেবে বিভ্রম হয়েছিল। উঠে বসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল- “না আমি ভেবেছিলাম, তুই রাগ করেছিস। আচ্ছা আমি এখন আসি”
খুব দ্রুত উঠে চলে গেল হাসান। বাইরে তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। হাসান ভীষন রকম অনুশোচনায় ভুগছে, সে এটা চায় নি। জয়া তার বেস্ট ফ্রেন্ড, কান্তা তার প্রেম, তার পূজা। সে কিনা নিজের সব গৌরব খুইয়ে বসল এমন একজনের কাছে, মা ছাড়া যে তার সবচেয়ে আপনজন কিন্তু প্রেম নয়। উফফ, নিজেকে অসহ্য বিরক্তিকর লাগছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আজ আর মেসে ফিরবে না সিদ্ধান্ত নিল হাসান। ভালবাসাহীন কোন শারীরিক স্পর্শ তার সত্যি ঘৃণার কারন। নিজেকে তীব্র ঘৃণা হচ্ছে তার। হাসান ভাবলো মায়ের কাছে যাবে, কিছুটা শান্ত হওয়া তার খুব দরকার। আর কিছু না ভেবেই গুলিস্তান থেকে মুন্সিগঞ্জের বাসে উঠে বসল হাসান।
প্রচন্ড জ্বর নিয়ে যখন বাড়ি পৌছল হাসান, তখন রাত ১০ টা। কলিংবেলের শব্দে গেট খুলল মামাতো বোন তৃণা। “ভাইয়া, তুই হঠাৎ কোন খবর না দিয়ে””
তৃণাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গেটের উপরেই জ্ঞান হারালো হাসান। হাসানের ৬ ফুট ২ ইঞ্চির শরীরটা উপর এমনভাবে পড়ল, যে শব্দে পুরো বাসা মোটামুটি কেঁপে উঠলো। কপালের কিছু অংশ কেটে রক্ত বের হয়ে গেল, হাসানের মা-মামা হতভম্ব হয়ে গেলো। দ্রুত হাসানকে তুলে বিছানায় শোয়ালেন মামা আর তৃণা। হাসানের গা তখন পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।
হাসানের ওভাবে চলে যাওয়ার পর এক স্তম্ভিত অনুভূতি হচ্ছিল জয়ার, তার ছোট্টবেলার বন্ধু, জীবনের প্রথম প্রেম হাসান কে এভাবে সে কখনো চায়নি, কোন দিন ও ভাবে নি হাসান এর সাথে এইভাবে কোন সম্পর্কে জড়াবে। হাসানের খুব জ্বর ছিল, ওমন করে বেরিয়ে গেল, আজ রাত টা থেকে গেলে পারতো। কী করছে কে জানে, ভেবে ফোন দিল। দুইবার রিং হলো, কোন খবর নাই।
হাসানের জ্বর একটু কমলো শেষ রাতে। সে উঠে কী মনে করে মায়ের কাছে গিয়ে শুলো, মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাদঁতে লাগলো। হাসানের মা রাজিয়া বেগম, ভাবলেন হাসানের শরীর হয়ত খুব বেশি খারাপ লাগছে, কিন্তু হাসান শুধু কাদঁছে আর বলছে- মা, আমি খুন বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। রাজিয়া বেগম কিছুও বুঝতে পারছেন না। তবু বলছেন
“শান্ত হও বাবা, কী হয়েছে! সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি ভুল বুঝতে পারলে অবশ্যই ক্ষমা পাবে। কী ভুল হয়েছে”
হাসান কিভাবে কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল-
“মা আমি আমার এক বন্ধুর সাথে বিরাট অন্যায় করে ফেলেছি”
হাসানকে শান্ত করার জন্য মা বললেন “বন্ধুই তো মাফ চেয়ে নাও, আল্লাহ ও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করেন, আর তোমার বন্ধু তো মানুষ”
হাসান জয়ার কাছে ক্ষমা চাইবার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু কিভাবে মুখোমুখি হবে সে জয়ার, কান্তাই বা কী ভাববে এটা শুনলে। হাসান টেনশান টা আর নিতে পারছিল না। ভাবলো একটু সুস্থ হয়ে ঢাকায় গিয়েই সে প্রথমেই মুখোমুখি হবে জয়ার। নিজের বিছানায় শুতেই চোখ বুজে আসলো হাসানের। ঘুম ভাংলো দুপুরের পর।
ফোন হাতে নিতেই দেখলো ৫২ টা মিসকল জয়ার। হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলব্যাক করলো। ফোন ধরলেন জয়ার মা। যা শুনলো তা শুনতে প্রস্তুত ছিল না হাসান। হাসানকে খুঁজতে হাসানের মেসে যাওয়ার পথে একসিডেণ্ট হয়েছে জয়ার। মাথায় দুইটা স্টিচ লেগেছে। এবার আর হাসানের কিছুই ভাল লাগছিল না। কোনরকমে দুইটা নাপা খেয়ে ছূট লাগালো ঢাকার উদ্দেশ্যে।
জয়া চোখ মেলে দেখে তার পাশে মুখ শুকনো করে বসে আছে হাসান। জয়াকে তাকাতে দেখে হাসান বলল “” কেমন লাগছে””
“তোকে দেখে খুব ভাল লাগছে”
“আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম জানিস”
“কী ভেবেছিলি মরে যাবো!”
“ধুর না! আমাকে খুজঁতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করেছিস শুনে আমার খুব অনুশোচনা হচ্ছিল”
“তুই ফোন ধরছিলি না কেন”
“মায়ের কাছে গিয়েছিলাম, জ্বর ছিল যে”
হাত বাড়ালো জয়া, এগিয়ে দিল নিজেকে হাসান, হাত দিয়ে জ্বর দেখে আঁতকে উঠলো জয়া, “এত জ্বর নিয়ে এখানে বসে আছিস কেন? আজব! মা এই মা, ম”
“আরে আন্টি একটি বাসায় গেছে, আমাকে রেখে, চলে আসবে ঘন্টা খানেকের মধ্যে, তুই ভাবিস না””
“হাসান, আমার কাছে একটু আয়, একটা জিনিস বলতে চাই, কানে কানে”
লজ্জায় লাল হয়ে হাসান বলল বল-” শোন, তোকে বলিনি কখনো কিন্তু আজ বলতে আর দ্বিধা নেই, তোকে আমি ভালবাসি হাসান। তুই এত বোকা কেন আমাকে কান্তার কথা বলে শুধু জেলাস করতি, তুই ও যে ভালবাসিস এটা বলতে এত নাটক করতে হলো!” খুব আদুরে গলায় বলল জয়া।
হাসান কী বলবে ভেবে পেলো না, জয়া পুরো ব্যপারটা অন্যভাবে ব্যাখা করছে। হাসান সত্যিটা বললে কী ভাবে রিয়াক্ট করবে বুঝতে পারছিল না। জয়া বলে উঠল-“বিয়ে করবি আমাকে!”
হাসান কী বলবে বুঝতে পারছিল না। এর মাঝেই জয়ার মা চলে আসলো। হাসান ফিরে গেলো মেসে। হাসানের জ্বর সারতে আরো বেশ কিছুদিন লাগলো, ফোনেই টুকটাক কথা হচ্ছিল জয়ার সাথে। জয়া দ্রুতই সেরে উঠছিল। এর মাঝে সপ্তম আশ্চর্যের মত, হাসান এক সকালে আবিষ্কার করলো তার বিছানায়, তার পাশে শুয়ে আছে জয়া! মোটামুটি লাফ দিয়ে উঠলো হাসান।
“তুই, এখানে এভাবে!! কেন”
“হ্যাপী বার্থ ডে “
হাসান ভুলেই গিয়েছিল আজ ওর জন্মদিন।
“কিন্তু তুই এভাবে এখানে আমার বিছানায় কেন, গেট কে খুলে দিল! সবাই কী ভাবছে ছি ছি”
“সবাই খুব ভাল ভাবছে, গেট খুলেছিল রাহি, আমি ওকে বলেছি ওদেরকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য বলা হয় নাই, আমরা বিয়ে করেছি”
“কী! মিথ্যে কেন বলেছিস, তাও আবার এত বড়””
“তুই এমন করছিস কেন, বিয়ের কী বাকি আছে নাকি কিছু, নাকি তুই শুধু সেদিন কিছুক্ষণ টাইম পাস করেছিস আমার সাথে?”
হাসান কী বলবে ভেবে পেল না। “তাই বলে সবাইকে এভাবে বলতে গেলি কেন?”
“চুপ করতো আগে মুখ ধুয়ে কেক কাট”
সেদিনের পর থেকে তারা অলিখিত স্বামী-স্ত্রী, অন্তত বন্ধু মহলে, প্রথম প্রথম হাসানের কিছু দ্বিধা ছিল, জড়তা ছিল। কিন্তু জয়ার তীব্র ভালবাসা, হাসানকেও জয়াকে ভালবাসিয়েছে।। কান্তার জায়গাটা কখন যে একটু একটু করে দখল করে নিয়েছে জয়া হাসান বুঝতেও পারেনি। হাসানের পৃথিবী এখন জয়া।
এর মাঝে পার্ট টাইম একটা জব পেয়ে যায় হাসান। জব পেয়ে আলাদা একটা ছোট ফ্ল্যাট নেয় সে, এর মাঝেই জমে উঠে তাদের লাল নীল সংসার। হাসান ভেবেছিল মাস্টার্সের পর মা-কে সব জানাবে। এদিকে জয়ার মূল ভয়টা ছিল বাবাকে নিয়ে, ভিন্ন ধর্মের একটা ছেলে কে কী জামাই হিসাবে মেনে নেবেন বিখ্যাত সংবাদিক পূলক সেন! বাবার ভয়ে আজ পর্যন্ত সব কিছু খুব বেশি গোপন করে রেখেছিল জয়া। কিন্তু এর মাঝেই প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ে সে। হাসানের মাস্টার্স পরীক্ষার মাঝে জয়া যখন এই ব্যাপারটা জানতে পারে, সে হাসানকে জানানোর একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করে যে হাসানের শেষ পরীক্ষার দিন ই সে জানাবে সব।
কিন্তু পরীক্ষা শেষ হয় ১.৩০ টায়, বিকাল ৪ টায় ও ফিরলো না হাসান। যদিও এক সাথেই লাঞ্চ করার কথা তাদের। কখনোই হাসান কথার বরখেলাপ করেনি। হাসানের সব প্রিয় খাবার রান্না করেছে আজ জয়। লাল শাড়ী পড়ে খুব সুন্দর করে সেজেছে আজ জয়া। আর বাসার ড্রয়ারে মা-কে সব জানিয়ে চিঠি লিখে রেখে এসেছে। আজ আর বাড়ী ফিরবে না সে। হাসানেএ সাথেই বাকী জীবন কাটাবে সে, এই সিদ্ধান্তেই ঘর ছেড়েছে সে। একদিকে জয়াকে পুরোপুরি পাওয়া অন্যদিকে বাবা হবার আনন্দে হাসানের রিয়াকশান কেমন হবে ভাবতেই এত ভাল লাগছিল জয়ার। বিছানায় পিঠ এলাতেই ঘুমিয়ে গেল সে। ঘুম ভাংলো যখন প্রায় সন্ধ্যা। হাসান ও ফেরেনি এখনো। এদিকে পরীক্ষা হলে ফোন নেয়া নিষেধ বলে, হাসানের ফোন টিও টেবিলের ওপর সুইচড অফ। ভীষন ভয় আর শংকায় পড়ে গেছে জয়া। কী ভেবে যেন টিভির সুইচ টা অন করে চ্যানেল বদলাচ্ছিল।
হঠাৎই ভয়ের এক শীতল স্রোত বয়ে গেলো জয়ার মেরুদন্ড বেয়ে এক ভয়ংকর সংবাদে।
চলবে
আরো পড়ুনঃ
নিয়তি পর্ব ০১
[…] নিয়তি-০২ […]
[…] নিয়তি- পর্ব ০২ […]