
কিছু বই হয় নদীর মত। সাঁতার কেটে একের পর এক টুকরো গল্প পেরিয়ে ওপারের কিনারে পৌছাতে হয়। আর কিছু বই হয় সমুদ্রের মত। সেই সমুদ্রের ঘটনা গুলোর সাথে, চরিত্র গুলোর সাথে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে হয়। ভাসতে ভাসতে কখন যে পাড়ে আছড়ে পড়া যেন টের পাওয়া যায় না। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কাছের মানুষ ঠিক যেন তেমন এক সমুদ্র।
বাবা-মা, আত্নীয়, বন্ধু, পড়শি সবার সাথে মিলেমিশে থেকেও যে আমরা প্রত্যেকে কতটা গভীরভাবে একা, কতশত সম্পর্কের ভিড়ে আমরা যে কতটা গভীরভাবে সম্পর্কহীন সেটার একটা স্বচ্ছ চিত্র এই বইটি।
ইন্দ্রাণী ভালোবেসে ছিল শুভাশিসকে। কিন্তু বুকে কমিউনিজমের মশাল জ্বালিয়ে শুভাশিস একদিন কোথায় হারিয়ে গেল। ওদিকে ইন্দ্রাণীকে মেনে নিতে সময়ের নিয়ম। ইন্দ্রাণীর সাথে বিয়ে হয়ে গেল আদিত্যর। অনিচ্ছুক, অসাড় মৃতপ্রায় শরীর আদিত্যকে দিয়ে ইন্দ্রাণীর সংসার চলছিল একরকম। একটা সন্তানও এলো। বাপ্পা। কিন্তু সব হিসেব উলোটপালট করে একদিন শুভাশিস ফিরে এলো। শুভাশিসও ততদিনে সংসারী। ছন্দা নামের সুন্দরী স্ত্রী ঘরে।
কিন্তু সংস্কার আর সংসারের কেটে দেয়া গন্ডি কেউ মেনে নিলো না। শুভাশিস আর ইন্দ্রাণী আবার দুর্বল হয়ে পড়লো। শরীরের সাথে শরীরের কর্ষণে মেতে উঠলো অতৃপ্তি আর না পাওয়াকে মুছে দিতে। ইন্দ্রাণীর গর্ভে আবার সন্তান এলে। মেয়ে সন্তান। তিতির। তবে এইবার পিতৃত্বের অহংকারের ভাগি হতে পারলো না আদিত্য। জানলোও না।
তারপর সময় গড়াল। শুভাশিসের বৈধ সন্তান টোটো বড় হল, অজ্ঞাত কন্যা তিতির আদিত্যর পরিচয়ে কৈশোরে উঠলো। ইন্দ্রাণীদের ঢাকুরিয়ার প্রাচীন বাড়িটা আদিত্যর ছোট ভাই কন্দর্পকে ব্যবহার করে নিয়ে নিলো ধুরন্ধর প্রমোটার অশোক মোস্তাফি। অবশ্য বিনিময়ে কন্দর্প ফিল্মে সুযোগ পেল। সেই আক্ষেপ বুকে নিয়ে প্রথমে চলে গেলেন আদিত্যর পিতা জয়মোহন।
তার বেশ কিছু পরে শুভাশিসের পিতা মাধবপুরের ডাক্তার শিবসুন্দরও চলে গেলেন। সম্ভবত এই উপন্যাসের সবথেকে লিবারেল আর ম্যাচিউরড চরিত্র ছিলেন শিবসুন্দর। মাধবপুরের মানুষের সেবার নিজেকে করেছিলেন নিয়োজিত কিন্তু নিজেকে উজাড় করেছিলেন স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার নিরলস সংগ্রামে। যে স্ত্রী একটা জড় বস্তু অধিক কিছু নয় সেই স্ত্রীর জন্য এই মানুষটার লড়াই দেখে মনে হয়েছে হোক উপন্যাসে তবুও ভালোবাসা আজও বেঁচে আছে। ভালোবাসায় বিশ্বাস হারাতে নেই।
গল্পটা মূলত মা ইন্দ্রাণী আর মেয়ে তিতিরকে নিয়ে। নিজের পেটের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ইন্দ্রাণী জানত তাদের সম্পর্কের মাঝে পুরোটাই যেন ফাঁকি। আচ্ছা তিতির যদি কোনদিন জানতে পারে তারা প্রকৃত পিতার পরিচয় ও কি মেনে নিতে পারবে? ওর পুরোটা জুড়েই তো বাবা আদিত্য। মাতাল, অপদার্থ, বাস্তববুদ্ধিহীন কিন্তু বাবা আদিত্যকে ছাড়া যে তিতির আর কাউকে ততটা আপন করতে পারে না। কি করে মেনে নিবে তিতির? আর সেদিন কি ইন্দ্রাণী তিতিরের চোখে চোখ রাখতে পারবে? নাকি পালিয়ে যাবে?
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট
[…] কাছের মানুষ- সুচিত্রা ভট্টাচার্য […]