
প্রায় ৬০০ বছর আগের কথা। হিমালয়ের ঐপাশ অর্থাৎ তিব্বতের খাম নামক জায়গা থেকে একটি জাতি দলে দলে নিজেদের জন্মস্থান ছেড়ে, হিমালয়ের দুর্গম দেয়াল টপকিয়ে চলে এল এর দক্ষিণ পাড়ে, হিমালয় কন্যা নেপালে। বর্তমানে এই জাতিকে আমরা ‘শেরপা’ হিসেবে জানি।
নৃতত্ত্ববিদরা ধারণা করেন বৌদ্ধধর্মের মাহায়ানা ঘরানার মধ্যকার সংঘাতের ফলেই শেরপারা দেশান্তরী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমাদের অনেকেরই ধারণা আছে তিব্বতের লোকেরা বুঝি খুব শান্তশিষ্ট, অহিংস। মূলত বর্তমান দালাইলামার শান্ত সৌম্য কথাবার্তা শুনেই আমাদের এই ধারণা হয়ে গেছে হয়ত। কিন্তু অন্য সব সমাজের মত তাদের মধ্যেও যুদ্ধ বিগ্রহ, সংঘাত, হানাহানি মারামারি আছে।
শেরপাদের গ্রামে বসে বাতাসে দোল খাওয়া বাজরা ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে মনে হল, পুরোপুরি বিপরীত একটি প্রকৃতিতে মাইগ্রেশনের পর তাদের এডাপ্টেশন নিয়ে। বিশেষ করে জীবনধারণের সবচেয়ে বেসিক যেই জিনিস – সেই চাষাবাদের এডাপ্টেশন নিয়ে।
তিব্বতের ভূমিরূপ সম্পর্কে যদি আপনার ধারণা থেকে থাকে তাহলে জানবেন সেখানে প্রায় সমতল জায়গাতেই চাষাবাদ হয়ে থাকে। পুরো তিব্বত জুড়েই বিশালকায় চওড়া উপত্যকাগুলোতে আমাদের সমতলের মতই খন্ড খন্ড করে চাষের জমি থাকে। সাধারণত গ্রামের চারপাশ ঘিরেই থাকে এসব জমি। এমন জমিতে চাষাবাদ করার পদ্ধতি একরকম। কিন্তু হিমালয় পেড়িয়ে যখনই আপনি দক্ষিণে চলে আসবেন, এখানকার পাহাড়গুলো অত্যন্ত খাড়া। উপত্যগুলোও প্রশস্ত নয়। এমন দূরহ জায়গায় চলে এসে কিভাবে তারা প্রকৃতির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিল। কিভাবে তাদের মাথায় আসলো, এই বিশাল পাহাড় কেটে ধাপ বানিয়ে চাষাবাদ করা সম্ভব। ধাপ শুধু কাটলেই তো হবে না, বৃষ্টিতে যেন উপরের উর্বর মাটি ধুয়ে না যায় তার জন্য ধাপ ঘিরে পাথরের শক্ত দেয়ালও বানাতে হবে।
মানুষ খুবই অদ্ভুত প্রাণী। তার মত প্রকৃতির সাথে মানিয়ে নেয়ার মত সক্ষমতা বোধ হয় খুব কম প্রাণীরই আছে। মানুষ অবশ্য তেলাপোকার সাথেই পারবে না। হাজার হাজার বছর আগের সুমেরিয়ানদের তৈরি ঝুলন্ত বাগান আসলে এভাবেই ধাপ কেটেই বানানো হয়েছিল। আন্দিজের ইনকারাও এভাবেই ধাপ কেটে চাষাবাদ করত। বাংলাদেশের দক্ষিণেও কিন্তু শত বছর ধরে বন্যার পানিতে কচুরিপানা দিয়ে ধাপ বানিয়ে তার উপর চাষাবাদ করা হয়। আলাদা আলাদা প্রকৃতি, আলাদা আলাদা জাতি, কিন্তু সবার লক্ষ্য একটাই, প্রকৃতিতে টিকে থাকা।
লেখাঃ সালেহিন আরশাদি