নিয়তি- পর্ব ১

নিয়তি

আজ হাসানের শেষ পরীক্ষা, পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই তাকে সুখবরটা দিবে জয়া, তাই অপেক্ষা করছে হাসানের বাসায়। হাসানের হবে কেন, বাসাটা হাসান আর জয়ার দুজনেরই। ভাবতেই হাসলো জয়া। এই বাসাটা সে মনের মতো সাজিয়েছে, ছোট্ট একবেড রুমের একটা বাসা, সামনে একটু ডাইনিং, খোলা ছাদের ধার ঘেরা ফ্ল্যাটের পেছনের দিকে রান্নাঘর আর ওয়াশরুম। খুব প্রিয় জয়ার এই বাসাটা। তার আর হাসানের নিজেদের বাসা, খুব কষ্ট করে একটু একটু করে এই সংসার গড়েছে তারা। কত বয়স হবে ওদের, ২৩ বছরে পড়ল হাসান, জয়া ২৪ এ। ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু তারা। বছর তিনেক হলো হাসান আর জয়ার সংসারে। সেইদিনের কথা খুব মনে পড়ে জয়ার, ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন ও……..

জয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড কান্তার বয় ফ্রেন্ড ছিল তখন হাসান, তারা তিনজন ছোটবেলার বন্ধু, একসাথে স্কুল শেষ করেছে। ভীষন সুপুরুষ হাসানের প্রতি অনেকের মেয়েরই ক্লাশ থাকলেও হাসানের মন প্রাণ আত্মা সব টা জুড়ে কেবল কান্তা। কান্তাও হাসানের জন্যই যেন জন্মেছিল। স্কুলের সবাই জানতো তাদের ব্যাপারটা। কান্তার বোনেরাও জানতো। কান্তা আর হাসানের প্রেমের সাক্ষী ছিল তাদের কমন ফ্রেন্ড জয়া। জয়া ও যে হাসান কে খুব পছন্দ করতো না এই কথা জয়া নিজেও কখনো অস্বীকার করতে পারবেনা। তবুও বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রেমিক কে বন্ধুর বেশি কিছু নিবেদন করতে রুচি হয় নি কখনো। এইচ এস সি পরীক্ষার আগে হঠাৎই মারা গেলেন হাসানের বাবা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে গেলেন এন হাসানের মা, কোনরকমে হাসানের এইচ এস সি সি পরীক্ষার পর সব গুটিয়ে চলে গেলেন গ্রামে। সেখানেও বিপত্তি, দাদী বেচেঁ থাকায় চাচারা কেউই সম্পত্তি বুঝিয়ে দিল না হাসানের মা-কে। অসহায় হাসান আর তার মা আশ্রয় নিলেন হাসানের নানা বাড়ীতে। হাসানের মামা অনেক আন্তরিকতায় গ্রহন করলেন হাসান আর তার মা-কে। এইচ সি পর হঠাৎ গ্রামে চলে যাওয়া আর হাসানের জীবনের টানা পোড়নে আস্তে আস্তে কান্তা কেন যেন হাসানের থেকে দূরে সরে গেল, হাসান চাইলেও সহজে যোগাযোগ করতে পারছিল না।

হাসান সাহস করে একদিন মুখোমুখি হলো কান্তার।

“কী, ব্যাপার এড়িয়ে চলছিস নাকি”

“এড়িয়ে চলার কিছু নেই, এমনি সময় পাই না, বাইরে পড়তে যাব, আই ই এল টি এস দিব, বিজি”

“দ্যাখ আমি সোজা সাপ্টা কথা আশা করছি, কী হয়েছে বলবি!

” ওয়েল, হাসান আমার মনে হয় আমি আসলে তোর প্রতি আর ছোটবেলার ফিল টা পাচ্ছিনা, ইউ সিম কিন্ডা বোরিং টু মি”

“ইজ দ্যাট সো! অর ইউ ফাইন্ড মি এ বিট ইন ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস!”

“শোন অতো রুড ভাবছি না, আসলে আমার মনে হয় আমাদের আর কোন ইস্যু নেই, আমাদের ব্রেক আপ টাই বেটার”

“কান্তা আমি ভাবতেই পারছিনা, তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো নারে”

“প্লিজ, সিনেমার ডায়ালগ দিস না, ঠিক হয়ে যাবে সব” আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কান্তা হেটেঁ বেরিয়ে গেল হতবিহ্বল হাসানের সামনে থেকে। হাসান পুরোপুরি ভেংগে পড়ল। উদভ্রান্ত হয়ে গেল সে।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে এইচ এস সি তে বোর্ড স্ট্যান্ড করে বসলো হাসান বিন হাফিজ। আমাদের এই গল্পের প্রধান চরিত্র “হাসান”

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে ঢাকায় এক মেসে উঠলো হাসান, ঠিক মেস না তিনবন্ধু মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল আগারগাঁও এ, ওদের আগের বাসার কাছেই। এর মাঝেই কান্তা জানালো হাসানের সাথে আর কন্টিনিউ করতে চাচ্ছে না। ঝড় বয়ে যাচ্ছিল হাসানের উপর দিয়ে, পুরানো বন্ধুদের অনেকের সাথে ইচ্ছে করেই যোগাযোগ কমিয়ে দিল হাসান। কিন্তু জয়া নাছোড়বান্দার মতো ঝুলে রইলো। হাসানের খবরাখবর খুব ভালই নিচ্ছিল বাসা থেকে মাঝে মাঝে রান্না করে আনছিল বাবা-মায়ের চোখ ফাকিঁ দিয়ে। হাসানের অন্য বন্ধুদের সাথেও খুব জমতো জয়ার। সবাই মিলেই গ্রুপ স্টাডি করত। কান্তার চলে যাওয়ায় বিপর্যস্ত হাসানের পাশে খুব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল জয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিল হাসান। হাসানের চেয়ে বেশি খুশি জয়া। কিন্তু জয়া চান্স পেল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অন্য বন্ধুদের মাঝে হাসান ছাড়া চান্স পেয়েছিল আর একজন।

হাসানের সাথে জয়ার বন্ধুত্বটা জমে উঠেছে বেশ, জয়াদের বাসায় অবাধ যাতায়াত হাসানের। ছোটবেলায় হাসানদের স্বচ্ছলতার কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন জয়ার মা ও, তাই প্রায়ই বাড়ীতে ডেকে ভালমন্দ খাওয়ান তাকে। মামার আর্থিক সাহায্য আর বাবার জমানো কিছু টাকায় বেশ ভালই চলছিল হাসান আর ওর মায়ের। তবু হাসান ক্লাসের ফাঁকে কিছু টিউশানি করে নিজের খরচ চালায়। কান্তার জন্য তীব্র এক কষ্ট পুষে রাখে সে মনে। জয়া অনেক চেষ্টা করেও সে কষ্ট মন থেকে মুছতে পারেনা।

ইদানীং বেশ সিগারেট ধরেছে হাসান, অসহ্য বিরক্ত লাগে জয়ার।

“সিগারেট খাওয়াটা তোর জরুরী কেন?”

” তোকে কৈফিয়ত দিব ক্যান, দেখছিস না তোর বান্ধবী কেমন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, আমি জ্বালায় দিব সব”

“ধূর, শোন আমার মনে হয় কান্তার কোন উপায় ছিল না বলেই এমন করেছে, দেখেছিস না কারোর সাথে আর যোগাযোগ নেই “

“জানিস আমি কিন্তু জন্মেছি শুধু কান্তার জন্য”

এই কথাটা অসহ্য বিরক্তিকর ঠেকলো জয়ার কাছে। উঠে গিয়ে সিগারেট টা টান দিয়ে ফেলে চলে গেল একটা রিক্সা ডেকে। পরের কয়দিন আর খোজঁ নেই জয়ার।

সেদিন বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে টিউশানিতে গিয়েছিল হাসান, ফেরার পথে ঝুম বৃষ্টি। আজ ছাতাও নেই সাথে, দুই গলি পরের জয়ার বাসা। কিভেবে সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় সে হাজির হলো জয়ার বাসায়। বাসায় নক করতেই জয়া গেট খুলে ভেতরে আসতে বলল, কাক ভেজা হাসান কে। হাসানের চুল বেয়ে তখন বৃষ্টির পানি ঝরছে, মুগ্ধ হয়ে দেখছিল জয়া।

“টাওয়াল দে না একটা, আর আন্টিকে বল না আমায় একটু চা দিতে””

“বাসায় কেউ নেই হাসান, তুই বয় আমি চা করে দিচ্ছি”

টাওয়াল দিয়ে চা করতে গেল জয়া, ভেজা শার্ট টা কী ভেবে যেন খুলে টাওয়াক পেঁচিয়ে বসল হাসান। সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পড়ল ক্লান্ত শ্রান্ত হাসান। চা হাতে রুমে ঢুকে হাসানের এই অবস্থা দেখে খুব মায়া হলো জয়ার, কাছে গেল ওকে ঠিক মতো শুইয়ে দিতে।

ঠিক তখন…..

মন্তব্য (1)

মন্তব্য করুন