
নানাকে দেখতে হাসপাতালে যাবার উত্তেজনার মাঝে ফারিয়ার ম্যাসেজে আমি খুব ই বিহবল হয়ে উঠলাম। তবু ও মন শক্ত করে নানার কেবিনে ঢুকলাম। বাবা এখনো খুব একটা ভাল করে হাটতে পারেন না, আমি ধরে নিয়ে ঢুকলাম। সাদা সফেদ চাদরে ঢাকা এক বৃদ্ধ শুয়ে আছেন, হাতে ক্যানোলা করা, স্যালাইন যাচ্ছে বুঝতে পারলাম, পাশে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডার বলে দিচ্ছে, হরহামেশাই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। বাবা সালাম দিলেন, চোখ মেলে তাকালেন আমার নানা রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট জাজ রুহুল আমিন। আমাকে দেখে মৃদু হাসলেন, বাবাকে বললেন কেমন আছো টগর? বাবা উত্তর না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলেন-‘ আপনি কেমন আছেন বাবা”? ‘মৃত্যুর দিন গুনছি আমি, এই হ্যান্ডসাম কী আমার অয়ন”? নানার গলায় অসম্ভব আদর মাখা ছিল, উনি হাত বাড়িয়ে দিতেই আমি হাত টা ধরলাম, উনি আমার হাত ধরে উঠার চেষ্টা করতে চাইলেন, আমি উনাকে ধরে বসালাম। উনি আমাকে কাছে ডেকে নিলেন তারপু শীর্নকায় হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরে, আমার কানে ফিসফিস করে বললেন- “ক্ষমা করো আমাকে নানা ভাই, আমার ভুলে মা ছাড়া কেটেছে তোমার জীবন”। অনেক অনেক আদরের সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন আমার, আমার চোখ দিয়ে তখন অঝোর রোদন। নানা ভাই ও কাঁদছেন। বাবার চোখেও জল। পরিস্থিতি সহজ করতে বাবা বললেন- ‘বাবা, আগামী শুক্রবার অয়নের বিয়ে, আমার খুব পছন্দের একটা মেয়ের সাথে।
নানাভাই আমাকে আলগা করে বললেন, কে ফারিয়া? বুঝলাম নানা সব ই খবর রাখেন। ‘ফারিয়ার বাবা এসেছিল দাওয়াত দিতে’ আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানলাম ফারিয়ার বাবা নানার পূর্ব পরিচিত, আমার নানা না জেনেই দাওয়াত দিয়ে গেছেন নানাকে। ‘টগর, ফারিয়া সব জেনে বিয়ে করছে?’ ‘দেখো কাউকে ঠকিও না, নিজের জীবনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছ আশা করি’
‘ বাবা, ফারিয়া সব জেনে শুনেই রাজি হয়েছে’
আমি দ্রুত বললাম- এসব কথা থাক।
বাবা একটু বিরক্ত হলেন, তারপর নিজেই বলে চললেন- ‘বাবা, আমি চাচ্ছিলাম অয়নের বিয়ে তে ওর মা আসুক, আমি না হয় তার সামনে আসবো না। জীবনের গুরুত্বপূর্ন একটা দিন আমার ছেলের। সে তো জীবনে মা কে পায় নি, এই দিন টা তে না হয় দোয়া করে দিয়ে যাক’
নানা ভাই- নিশ্বাস ফেলে বললেন ‘ টগর, তুমি তো সবই জানো, আমি জানিনা সে আসবে কিনা, তবে আমি চেষ্টা করবো’
নানা ভাই আরো অনেক্ষন আমার সাথে অন্যান্য অনেক বিষয় নিয়ে গল্প করলেন, আমার খুব পছন্দ হলো উনাকে। মনে হচ্ছিল এত আপন এত কাছের। এতদিন দেখা হয় নি কেন ভেবে খুব খারাপ লাগছে। উনি অসম্ভব বিচক্ষন বুঝতে পারলাম যখন বললেন, ‘অয়ন আমি খবর পেয়েছি তুমি বাসা থেকে রেহানাকে সরাতে পেরেছ, আর সাব্বিরকেও রেহানার কাছ থেকে দূরে রেখেছ। তোমার বাবা এই কাজ টা করতে পারলে আজ হয়ত তোমার কষ্ট কম হতো’
‘কিন্তু অয়ন, মনে রেখো রেহানা অত্যন্ত ধুরন্ধর প্রকৃতির। তুমি খুব সাবধানে পা ফেলো, আমার মনে হয় তুমি তোমার বাবার সাথেও পরামর্শ করতে পারো, এতদিনের পোড় খাওয়া তোমার বাবার, রেহানার সরূপ তো এতদিনে চিনে ফেলার কথা’
‘নানা, আপনার সাথে হাসপাতালে কে থাকছে? ‘প্রসংগ বদলাতে চাইলাম আমি
‘নানা হেসে বললেন, তোমার অনেক গুলো বোন আছে, জানো?
আমি খুব অবাক হলাম। ঠিক বুঝলাম না কী বলতে চাইছেন নানা। আমি বললাম- মা আবার বিয়ে করেছেন শুনেছিলাম, উনার সন্তানদের ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা আসলে’, কাচুমাচু গলায় বললাম আমি। হা হা হা করে হাসলেন নানা, তোমায় কে বলল যে তোমার মা আবার বিয়ে করেছিলেন!! নিশ্চয়ই রেহানা। শোন সে সবসময় তোমাকে তোমার মায়ের কাছ থেকে আলাদা রাখতে চেয়েছে। তোমার বাবার সাথে ডিভোর্সের পর সে অনেকদিন দেশের বাইরে ছিল পোস্ট ডক্টরেট করতে গিয়েছিল, এর মাঝে বহু আগেই তার বিয়ের ইচ্ছা আর বয়স পেরিয়ে গেছে। তোমার মায়ের একটা এন জি ও আছে, সেটা তো শুনেছ নিশ্চয়ই। সুবিধা বঞ্চিত নারীদের নিয়ে কাজ করেন তিনি, অসম্ভব ব্যাস্ত তোমার মা, ঐ এন জি ওর মেয়েরা তোমার মাকে খুব ভালবাসে, আমাকেও । নানা ডাকে আমাকে। ওরাই পালা করে যাচ্ছে, আসছে। রাতে অবশ্য তোমার মা ই থাকেন। আজ তোমার মা আসলে আমি অবশ্যই তোমার বিয়ের সুসংবাদ টা দিব।
বাবা উঠতে চাইলেন,আমি ও একবার ফারিয়ার সাথে কথা বলব ঠিক করলাম, তাই বেরিয়ে এলাম বিদায় নিয়ে হাসপাতাল থেকে। গাড়ীতে উঠে ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে আমি নিজেই ড্রাইভ করতে লাগলাম। বাবা, তুমি কেন এতদিন সব লুকিয়ে রেখেছিলে, একটু বলবে?’ ‘ আমি তোকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকতাম রে, রেহানা তো একদিকে আমাকে ভয় দেখিয়েই রাখতো, তার উপর তোকে সমাজে স্বাভাবিক ভাবে উপস্থাপন করার জন্য আমাকে অনেক হিসাব নিকাশের মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে। আজ তোকে বিয়ে দিয়ে আমি তোর মাকে দেখিয়ে দিতে চাই, আমি কোন অন্যায় করিনি। তুই একটা স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের মত জীবনে আছিস’
‘বাবা, কিন্তু সেটা তো মিথ্যা, ফারিয়া বিপদে পড়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, স্বাভাবিক সময়ে হয়ত রাজি হতো না’
‘অয়ন তুমি এত বুদ্ধিমান, আর এটা বুঝ নাই ফারিয়া তোমাকে অনেকদিন ধরেই পছন্দ করে। হয়তো তার জীবনে অন্য কেউ ছিল বলে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে নাই। আচ্ছা বলতো, সে খুব ভাল করেই জানে তোমাকে বিভিন্ন তথ্য দিতে গেলে সে ঝামেলায় জড়াতে পারে, তবুও কেন তোমাকে সাহায্য করেছে??”
‘বাবা, আমি ওকে বলেছিলাম সে আমাকে সাহায্য করলে আমি ওকে চন্দনের সাথে বিয়ে দিতে হেল্প করবো’
বাবা খুব অবাক হয়ে বলল- চন্দন কে??
আমি বললাম- কেন ফারিয়ার প্রেমিক ছিল যে হিন্দু ছেলেটা, তার নাম চন্দন, না??
বাবা হাসতে হাসতে বলল- অয়ন, সরি আমাকে কিছু নাটক করতে হয়েছে, আমি জানতাম স্বাভাবিক সময়ে তুমি কিছুতেই বিয়েতে রাজি হবে না। তুমি যখন এই অফিসে জয়েন করলে তখন তার তোমাকে অসম্ভব ভাল লেগে যায়, একে তুমি তার বস। তার উপর আমাকেও সে খুব ভয় পায়, ও তার আগে বলে রাখি অয়ন, তোমাকে জানানো হয় নি, অফিসে আমার নিজস্ব গুপ্তচর সব সময়েই ছিল, এখনো আছে, তোমার প্রতিটা কর্মকান্ডের ব্যাপারে আমি সুক্ষ্ম নজর রাখছিলাম, আমি কোন হস্তক্ষেপ করিনি, কারন তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ আমার কাছে ঠিক মনে হয়েছে। ফারিয়া যে তোমার প্রেমে বিহবল সে আমি বুঝে ওকে ডেকে এনেছিলাম বাসায়, তার আগে তার পরিবারের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। ফারিয়ার বাবা-মা অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ। তোমার সব সমস্যা জানলে তারা তোমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবে না। আর তাই আমি ফারিয়ার সাথে খোলামেলা ভাবে সব কথা বলেছি। ফারিয়া তোমার ব্যাপারে খুব ডেসপারেট। আমি যখন তোমার শারীরিক অক্ষমতা তাকে বলেছি, সে শুধু বলেছে সংসার তো আমি অয়নের সাথে করবো, আপনার চিন্তা করতে হবেনা। এরপর সে সারোগেশানের মাধ্যমে মা হবার ডিসিশান নেয়, প্ল্যানটায় অবশ্য আমার পূর্ন সমর্থন ছিল, পুরো নাটক টা আমাকে সাজাতে হয়েছে’ বলেই সে বাবা হাসলো।
‘শোনো আমি সবসময় ই চাইতাম তুমি সব জানো, কিন্তু আমি নিজে বলতে পারতাম না তুমি কিভাবে রিয়্যাক্ট করো সেটা ভেবে কখনো বলিনি। আর ফারিয়াকে লিগ্যাল সব ডকুমেন্ট আমি ই ওকে দিয়েছি যাতে তুমি সব বুঝতে পারো’
কিছু থেমে বাবা বলল- কিন্তু অয়ন, তোমার মায়ের তোমায় নিয়ে কিছু প্রেজুডিস আছে। তোমার জন্মের পর তোমার সেক্স ডিটার্মিনেশান নিয়ে আমরা যখন জটিলতায় পড়েছিলাম, তোমার বাবার মনে রেহানার সত্য-মিথ্যায় ভরার গালগল্পের প্ররোচনায় সে এটাকে আমার পাপের ফল বলে আমাকে দোষারোপ করতে থাকে’।‘জানো অয়ন, আমি কিন্তু তোমার মা কে বিয়ের আগে রেহানার ব্যাপার টা তোমার নানাকে বলেছিলাম, কিন্তু উনি পুরো ব্যাপারটা চেপে যান আমাকেও বলেন আরে এসব কোন ব্যাপার না। আসলে তোমার মা আমার ক্লাস মেট ছিলেন, আমরা দুইজনেই একসাথে স্কলারশীপে বাইরে পড়তে যাবার সুযোগ পাই, তোমার নানা কিছুতেই মেয়েকে এক পড়তে পাঠাবেন না, তখন যখন শুনলেন আমি যাচ্ছি, আমাকে ডেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তোমার ক্যাম্পাস সেরা সুন্দরী মাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখাও আমার জন্য অসম্ভব কল্পনা ছিল। কিন্তু তোমার নানার আগ্রহে আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়। ভিন্ন একটা দেশে, ভিন্ন একটা পরিবেশে তোমার মায়ের সাথে আমার খুব সুন্দর একটা সময় কাটে, তীব্র ভালবাসায় ভরা একটা সংসার আমাদের ছিল। আমি একদম রেহানার সাথে বিয়ে বা ঐ ব্যাপার গুলো মোটামুটি ভুলেই ছিলাম। দেশে এসে রীতিমতো ধাক্কা খাই আমি। সাব্বিরের পিতৃত্বের দাবী আমাকে বিহবল করে ফেলে। তোমার মা আমার কোন কথাই মানতে নারাজ, উনার ধারনা ছিল আমার পাপের শাস্তি হিসাবে তুমি একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ’। ‘উনি আমাকে খুব ঘৃণা করে অয়ন, তোমার জেন্ডার আইডেন্টেটি ও তার জন্য ভীষন লজ্জার ছিল। কিন্তু বাবা বিশ্বাস কর, তোমার জন্মের পর তোমার মুখ যখন আমি দেখলাম, কী অপূর্ব দেব শিশুর মত তুমি ছিলে দেখতে, আমার মনে হলো আমার সারাজীবনের কষ্ট যেন নিমেষেই দূরীভূত হয়ে গেলো তোমাকে দেখে, তোমার মা হয় তো অনেক সময় আমার উপর রাগে, তোমাকে তৃতীয় লিঙ্গ কমিউনিটিতে দিয়ে দেয়ার জন্য বলেছেন, কিন্তু আমি কখনোই একটিবারের জন্য চিন্তা করিনি তোমাকে আমার কাছ ছাড়া করার জন্য’’ বাবা, অয়ন আমি তোমাকে ভালবাসি দুনিয়ার সব চেয়ে বেশি’। বাবার চোখে জল। আমি ও কাঁদছি। বাবা থেমে বললেন- ‘তবে অয়ন, হাসেম কে তোমার কিডন্যাপ করানো ঠিক হয় নি’।
‘কিন্তু বাবা আমি তো হাসেম মামা কে কিডন্যাপ করাইনি’
কী, তাহলে! হাসেম মামা কে কে কীডন্যাপ করালো।!!
আমার কন্ঠে রাজ্যের বিস্ময়!!। বাবার চোখ বিস্ফোরিত। এমন সময় আবার ও ফারিয়ার টেক্সট- ‘অয়ন, চন্দন ফিরে এসেছে’।