
আমি আর রেহানা আন্টি কথা বলার মাঝেই ফোন আসলো বাবার, “অয়ন, তুমি কোথায়, আমি তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে যাবো ভাবছি”
“বাবা, আমার ফিরতে দেরি হবে, কাল যাই”
“অয়ন, তোমার নানা তোমাকে দেখতে চাইছিলেন, উনি ডাইয়িং”
“কী, কোথায়! বাবা আমি আসছি, আমি এক্ষুনি আসছি”
আমার চরম উত্তেজনা চোখ এড়ালোনা রেহানা আন্টির। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। “কি হয়েছে অয়ন? তোমার বাবা কী অসুস্থ”?
” আরে না এমনি, আপনি আপনার কথা গুলো দ্রুত শেষ করে টাকা নিয়ে চলে যান প্লিজ”
“অয়ন, আমার মনে হয় আমরা অন্য কোনদিন কথা বলি”
এবার সত্যি আমার রাগ হচ্ছে-“আন্টি, তাহলে অন্য একদিন টাকাটা দিব”
চুপ করে থেকে রেহানা আন্টি বললেন- “তবে শোন, তোমার বাবার সাথে যেদিন আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম, সেদিন হাসেম গিয়েছিল গ্রামে আমার চাচার সাথে জমির ব্যাপারে ফাইনাল কথা বলতে।
আমি ইচ্ছে করেই ওকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিতেই এই প্ল্যান করেছিলাম। তোমার বাবার সাথে দেখা করতে গেলাম ছোট্ট সাব্বিরকে নিয়ে, তোমার বাবাকে দায়ী করলাম সাব্বিরের জন্মদাতা হিসাবে, তোমার বাবা- টগরের মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পড়ল। সে তোমার মা কে খুব শ্রদ্ধা করত।
আমি একসাথে ক্ষোভ আর ঘৃণার সাথে আবিষ্কার করলাম শুধু শ্রদ্ধা না তোমার বাবা তোমার মা- কে ভাল ও বাসে খুব বেশি। ঈর্ষায় আমার দু’চোখ ভেসে যাচ্ছিল, কিন্তু বুঝলাম গত কয়েক বছরে তোমার বাবার মন প্রাণ জূড়ে গেছে তোমার মা- ঐ মহিলা ডঃ ফারহানা রোজি। অসহ্য। আমার ইচ্ছা করছিল সব তছনছ করে ফেলি”
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম আমার মায়ের নাম কী!
“কেন তুমি জানো না! ডঃ ফারহানা রোজি।”রেহানা আন্টি চোখ কুচঁকে বলল।
আমি ঢোক গিললাম, না আমি ভুল শুনেছিলাম আমি এই জন্য আবার জানতে চাইলাম, আমার মনে তখন হাজার ড্রামের ডামাডোল, ডঃ ফারহানা রোজি, মানে প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী আর নারী নেত্রী ডঃ ফারহানা রোজী আমার মা! আমার সব টুকু বিস্ময় চেপে আমি উনার কথা শুনতে লাগলাম।
” তোমার মা, আমার টগরকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। টগর আমাকে বলল সব কিছু ভুলে গিয়ে হাসেমের সাথে এডজাস্ট করে নিতে, সে এমনকি আমাকে টাকা অফার ও করলো হাসেম কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। রাগে আমার সারাটা শরীর তখন জ্বলছে। আমার প্রথম ও শেষ ভালবাসা টগর আমাকে ভুলে গেছে! আমি চোখের পানি তে বুক ভাসিয়ে বললাম- সাব্বির যে তোমার সন্তান, তার দায়িত্ব তোমাকে নিতেই হবে। টগর অনেকবার আমাকে বোঝানোর ট্রাই করলো যে সে এখন বিবাহিত, সন্তানের বাবা তার সাথে কিছু সমস্যা এম্নিতেই তার ওয়াইফের চলছে সেখানে আমি যেন নতুন কোন ঝামেলা তৈরি না করে, সেই অনুরোধ সে বারেবার করছিল।”
আমি আড়চোখে দেখলাম তোমার মা তখন দূর থেকে আমাদের দেখছেন, আর সেটা বুঝতে পেরে আমি তোমার বাবাকে বলি সাব্বিরকে একটু আদর করে দিতে। টগর সাব্বিরকে জড়িয়ে ধরে অনেক অনেক আদর করে। এই দৃশ্য দেখে তোমার মা নিজের মত করে সব ভেবে নেন।
ঐ দিনই হাসেম আমার সেজ চাচাকে খুন করে ফেলে” এটুকু বলার পর আমি নিজেই বললাম-“আর সে খুনের মামলা থেকে হাসেম মামা কে বাচাঁতে আপনি বাবা কে আরো বেশি ব্ল্যাকমেইলিং শুরু করলেন, তাই না! কারন ততদিনে আপনি বুঝে গেছেন, বাবাকে আপনি হারিয়ে ফেলেছেন। আর তাই হাসেম মামাকে উদ্ধার করিয়ে নিজের বিবাহিত জীবন আবার ঝালিয়ে নেয়ার একটা অপশান আপনি খোলা রাখলেন, তাই তো?”
“তুমি খুব বেশি বুদ্ধিমান অয়ন, ঠিক তোমার অতি অহংকারি মায়ের মত”
“অয়ন, হাসেমের কেইসটার জন্য আমি তোমার বাবা কে কিছুই জানাইনি, বরং আমি চেয়েছিলাম হাসেম জেলে পচেঁ মরুক। কিন্তু হাসেম তোমার নানার সাথে যোগাযোগ করে, তোমার নানা আর প্রভাব-প্রতিপত্তি আর অনেক টাকা খরচ করে সেজ চাচার কেইস টা থেকে হাসেমের নাম সরানোর ব্যাবস্থা করে, হাসেম বেরিয়ে এসে তোমার নানার কাছে যায়। তোমার মায়ের কানে আমি আরো কথা লাগাতে থাকি, তোমার বাবাকে একজন হীন চরিত্রের পুরুষ হিসাবে উপস্থাপনের সব চেষ্টাই আমি করি”
এর মাঝে কোন এক ইস্যু তে তোমার বাবা-মায়ের কিছু মনোমালিন্য চলছিল, এই ব্যাপারটা আমি শিওর না, সম্ভবত তোমার বাবার ক্যারিয়ার প্ল্যানিং বা অন্যকিছু। আমি সাব্বিরের পিতৃত্বের দাবী নিয়ে এক সন্ধ্যায় হাজির হলাম তোমাদের বাসায়, ও একটা কথা বলা হয় নি, আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন তোমার বাবা- মা তোমার নানার বাসা ছেড়ে নতুন বাড়িতে উঠেছিল আর তোমার নানার পরামর্শে ব্যাবসা শুরু করেছিলেন। আর নানার বাসার দায়িত্বে ছিল হাসেম। তখনো তোমার নানা বা মা জানতেন না হাসেম আমার স্বামী, আমি তাকে বলতে না করেছিলাম। তোমার বাবাকেও ভয় দেখিয়ে এই তথ্য বলতে বারণ করছিলাম। যে সন্ধ্যায় আমি তোমাদের বাসায় হাজির হলাম, সেদিন তোমার বাবা- মায়ের এম্নিতেই কোন ইস্যু নিয়ে ঝগড়া চলছিল, আমি গিয়ে সাব্বিরের পিতৃত্বের দাবী নিয়ে অনেক অনেক নাটক করি, এবং ঐ বাসায় উঠে আসার হুমকি দেই এবং মিডিয়া কে জানাব হুমকি দেই। তোমার বাবা খুব সোসাইটি কনশাস মানুষ ছিলেন, আর তাই লোকলজ্জার ভয়ে আমাদের ঐ বাসায় থাকার অনুমতি দেয়। এটা তোমার মা নিতে পারেন না। তোমাকে রেখেই সে ঐ বাসা থেকে চলে যায়। তোমার বয়স তখন ৯ মাস। তোমাকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়ে বাবা, অসম্ভব কষ্ট করেছেন তোমার জন্য। কিন্তু কোন এক অজানা কারনে তোমার কাছাকাছি কখনোই যেতে দেয় নি আমাকে। তোমার মাকে ফিরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছেন তোমার বাবা, এমনকি তোমার নানা ও তোমার বাবার পক্ষে কথা বলেন, কিন্তু তোমার বাবাকে মিথ্যেবাদী বলে সে ডিভোর্স লেটার পাঠায়, তোমার বাবার অসহায় অবস্থায় আমি আবার তার কাছাকাছি যাবার সুযোগ পাই যখন তোমার বাবা জানতে পারেন তোমার মা আবার বিয়ে করেছেন তোমার বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড কে।” “শোন অয়ন তোমার বাবা তোমার চেয়ে ভাল আর কিছু বা কাউকেই বাসে নাই আর তাই আমি হাজার চেষ্টা করেও সাব্বিরকে তার সন্তান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি, এমনকি আমি হাসেম কে তালাক্ক দিয়ে তোমার বাবার সাথেও আবার সংসার করতে চেয়েছি, উনি আমাকে কখনোই আর গ্রহন করতে চান নি, হ্যা সে আমাকে ভালবেসেছে অবশ্যই তবে সেটা অনেকটা বাধ্য হয়ে, কিংবা ছোটবেলার এক তীব্র প্রেম থেকে হয়ত। কিন্তু তোমাদ মায়ের প্রতি তার ভালবাসা ছিল অনেক অনেক বেশি, তার কাছাকাছি ও আমি যেতে পারিনি”
আমার আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করছিল না, তাই আমি উনার সামনে ২০ লাখ টাকায় ভর্তি একটা ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বললাম-” আপনি খুব সুক্ষ্ম ভাবে আমাদের একটা হাসিখুশি পরিবার ধ্বংস করেছেন, আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারবো না। আপনি নিজের জীবনটা ও দুর্বিষহ করেছেন, তার চেয়ে কষ্টকর কী জানেন আপনার যে সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা করার জন্য আমার জীবন টাকে আপনি স্নেহহীন করেছেন কিংবা আমার বাবা কী একটা নরমাল লাইফ ডিসার্ভ করতো না! এ কেমন সর্বগ্রাসী ঈর্ষা আমার! কী ভালবাসলেন আপনি টগরকে! ভালবাসা মানে কী কেবলই নিজের আয়ত্বে রাখা নাকি ভালবাসার মানুষের ভাল থাকার নিশ্চয়তার মাঝেও অনেক ভালবাসা থাকে! যাই হোন আন্টি আপনি যান, হাসেম মামা কে উদ্ধারের ব্যাবস্থা করুন। আশা করি আপনি নিজের ভুল বুঝতে পারবেন”।
আমি উনাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা খুলে দিলাম যাওয়ার জন্য।
উনিও ব্যাগটা হাতে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলেন। আমাকে এখন একটা পুরানো হিসাব মিলাতে হবে। বাবার কাছে যাবার আগে তাই আমি ডায়াল করলাম এক সাব্বিরের নাম্বারে, সাব্বিরকে আজ একটা জরুরি কাজের দায়িত্ব দিয়েছি আমি, কাজ টা করতে পারলে সে পাবে নগদ ২০ লাখ টাকা। জরুরি কাজের জন্য তাকে আমি ইন্ডিয়া যেতে দেই নি, খুব গোপনে শেষ মুহুর্রে তার যাওয়া ক্যান্সেল করিয়ে কনাদের পাঠিয়েছি, সাব্বিরকেও পাঠাবো তবে তা কালকের পরে। তার আগে বাবার সাথে নানা কে দেখতে যাওয়াটা আমার জন্য খুব জরুরী।
আমি রুদ্ধশ্বাসে পৌছঁলাম বাসায়, কিন্তু ততক্ষণে আমার জন্য আরো এক চমক অপেক্ষা করছিল। এই চমক আমাকে নাড়ীয়ে দিল অন্য এক অধ্যায়ে।
বাবাকে বাসা থেকে পিক করে হাসপাতালের দিকে, আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বাবা বললেন- অয়ন তোমার মা কে বিয়েতে দাওয়াত দিব!!
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম বাবার দিকে, এর মাঝে ফারিয়ার টেক্সট- “অয়ন, চন্দন ফিরে এসেছে” আমার পায়ের নিচের পৃথিবী তখন দুলছে।
Waiting for the next one.
Beautiful writing
অনেক ভাল লাগলো
Can’t control my tears.