
প্রথম প্রেম শেষ ভালবাসা
কাল ফারিয়ার ফোন কল পেয়ে জানিনা কিভাবে আমার সারাটা রাত কাটলো, খুব সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাবাকে বলে গেলাম, বাবা কনাকে একটু বলো যেন সাব্বিরকে হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসে, বাবা সরু চোখে আমার দিকে তাকালেন কিছু বললেন না। বাবার প্রতি ইদানিং আমার অসীম রাগ সত্ত্বেও আমাকে বোঝার রেয়ার একটা ক্ষমতা আছে বলে আমি বাবাকে অসীম ভালবাসি। বাবার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমাকে মনে করিয়ে দিল ছোট থেকেই বাবা আমার সব প্ল্যান আমার আগেই বুঝে ফেলে। আর সাধারনত যদি সেই প্ল্যান বাস্তবায়ন করা বাবার জন্য আমার চেয়ে সহজসাধ্য হয়, তবে তিনি তা করেন। আমি একটু হেসে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম।
আজ অফিসে মনে হয় আমি ই প্রথম এসেছি। অফিসে চাপরাশি আর পিওন রা ছাড়া কেউ ই নেই। আমি আমার রুমে ঢুকে ফারিয়া কে কল দিলাম, ফারিয়ার ফোন সুইচড অফ। আমার ভ্র কুচকে গেলো আপনাতেই। আমি পিওন কে ডেকে এক কাপ কফি দিতে বললাম। কফিতে চুমুক দিতে দিতে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলাম, সাধারনত আমি পত্রিকা পড়িনা। আজ নিজের অস্থিরতা কাটাতে পত্রিকায় মনোযোগ দিলাম। তৃতীয় লিংগের ব্যাক্তিদের অধিকার আর সমাজের দায় নিয়ে এক গোল টেবিল বৈঠকের সংবাদ পড়তে শুরু করলাম, যখন দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষক ও বিশিষ্ট নারী নেত্রী তার বিরোধপূর্ণ মতামত দিয়েছেন।
তাঁর মতে সন্তানের তৃতীয় লিংগের পেছনে বাবা-মায়ের খামখেয়ালিপনাও দায়ী। উনার মতে জন্মের আগেই সেক্স ডিটারমিনেশনকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রমোট করা উচিৎ। উনি বলতে চাইছেন যে সেক্স ডিটারমিনেশানের মাধ্যমে যদি দেখা যায় সন্তান টি ক্লীব বা হিজড়া তবে শিশুটির ভয়াবহ জীবন যুদ্ধের কথা ভেবে হয় শিশুটিকে টার্মিনেট করা উচিৎ অথবা সন্তান টি হবার পর রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসা উচিৎ। অন্য অংশগ্রহনকারীরা দেখলাম তার মতের বেশ সমালোচনা করেছেন। আমি আরেকবার নাম টির দিকে তাকালাম ফারহানা আমিন রোজি। তৃতীয় লিঙ্গ কে সরকার স্বীকৃতি দেয়ার পর ও আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গি খুব একটা বদলে যায় নি, ভাবছিলাম। এমন সময় টেক্সট ফারিয়ার নাম্বার থেকে আসলো- ‘স্যার, আমি একটু ঝামেলার আটকে গেছি, আমার আসতে লেইট হবে।
‘আমার কেন জানি না খুব টেনশান হচ্ছিল, আমি তাই কাজের মাঝে ডুবে যেতে চাইলাম। লাঞ্চের পর ফারিয়া শুকনো মুখে অফিসে ঢুকলো। হাসিখুশি ফারিয়াকে আজ কেন যেন খুব বিধ্বস্ত লাগছে। ফারিয়া সবসময়ই খুব পরিপাটি, আজ ই কেন যেন মনে হচ্ছে ওর ঠিক মতো ঘুম হয়নি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম- ফারিয়া, ঠিক আছো তুমি?? জ্বী স্যার, কিছু না বলেই আমাকে কোম্পানির ফাইল গুলো দেখাতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো, আমিও আসলে ফাইল গুলোর ব্যাপারে এতটাই কৌতুহলী ছিলাম যে ফারিয়ার সাথে আর কথা এগুলো না।রুহুল আমিন সাহেব তার গাজীপুরের সব প্রোপার্টি আমার নামে এবং কোম্পানির নামে হেবা করে দিয়েছেন, বাবাকে পাওয়ার অফ এটর্নী দেয়া ছিল আমার ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত।
সুতরাং আমি চাইলে এখন বিক্রি করতে পারি। রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট জাজ রুহুল আমিন সাহেব ঢাকার উত্তরায় থাকেন, এই খবর টুকু ফারিয়া বলতে পারলো, সে জানালো আব্দুল্লাহ চাচা ফারিয়াকে জানিয়েছেন কোন অবস্থাতেই যেন আমাকে উনার ঠিকানাটা জানানো না হয়। ফারিয়া আমাকে ব্যাগ থেকে বের করে একটা চিরকুট দিল- স্যার আমি অনেক ঝামেলা করে আপনার বাবা-মায়ের ডিভোর্সের ফাইল থেকে খুব দ্রুত ঠিকানা টা বের করেছি। অন্য কিছু এমনকি নাম টাও খেয়াল করার সময় পাই নি। মনে মনে আমি চমকালাম- আমার বাবা মায়ের তাহলে ডিভোর্স হয়েছিল।
মা মারা যান নাই, সাব্বিরের কথা তাহলে ঠিক, ওর বর্ন্না করা টুকরো ঘটনাগুলো আমাদের তথ্য কে সমর্থন করে যাচ্ছে। আমার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ছে রেহানা আন্টির উপর, উনার জন্যই তাহলে আমি মাতৃ স্নেহ বঞ্চিত, আমার বাবা তো আরেক কাঠি উপরে। নিজের প্রেম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমাকে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত রেখেছেন এত বছর, না জানি আমার মা কোথায় আছেন কেমন আছেন। কী ভেবে যেন দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে বেরিয়ে গেল আমার মুখ থেকে- ফারিয়া জানো আজ ই প্রথম আমি জানলাম আমার বাবা- মায়ের ডিভোর্স হয়েছে, আমি জানতাম আমার মা মারা গেছে। কী বলছেন স্যার!! সত্যি !! আমি তো আবদুল্লাহ চাচার কাছ থেকে জানলাম আপনার আম্মা খুব স্কলার ছিলেন, আপনার নানাও আপনার বাবাকে খুব ভালবাসতেন।
প্রতিবছর আমাদের কোম্পানির একটা শেয়ার আপনার নানার একাউন্টে পাঠানো হয়। আচ্ছা স্যার, আপনার মা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তা নিশ্চয়ই আপনি জানতেন।আজ মনে হয় আমার ধাক্কা খাওইয়ার দিন, এতদিনের চাপা সব তথ্য আজ আমার নার্ভাস সিস্টেমে আঘাত দিচ্ছে। ‘না, আমি জানতাম না- জানলে আমি অবশ্যই তাকে খুঁজে বের করতাম’স্যার আপনার এন আই ডি তে আপনার মায়ের নাম আছে না? আমরা সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরি থেকেও তাকে খুঁজে বের করতে পারব আশা করি। ফারিয়ার কথায় আমি বেশ আশার আলো খুঁজে পেলাম। দ্রুত ডিরেক্টরি যোগাড়ের ব্যাবস্থা করলাম।
এন আই ডি তে আমার মায়ের নাম দেয়া আছে- আবেদা ফারহানা, ডিরেক্টরি তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও এই নামের কাউকে পেলাম না, অর্থাৎ তথ্য ভুল আছে কোথাও, আমি খুব হতাশ বোধ করতে থাকলাম। আমার মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছিল তখন। ফারিইয়া বলল ভাইয়া চলুন বাইরে কোথাও বসে কফি খেয়ে আমরা আবার কাজ শুরু করি।ফারিয়ার সাথে কফিশপে বসে মাথা থেকে আগের সব চাপ মুক্ত হবার জন্য হাল্কা গলায় বললাম- ‘তোমার বয় ফ্রেন্ড কেমন আছে, ফারিয়া? তোমাদের বাইরে যাওয়ার প্ল্যানের কী হলো?’ ফারিয়া চুপ করে থেকে বলল- ভাইয়া কাল রাতে ও আমাকে কিছু না বলে চলে গেছে, ওর ভিসা কিংবা যাওয়ার ডেট সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ফারিয়া।
‘আল্লাহ কী বলো!! কিছুই বুঝতে পারো নি তুমি? এমন করতে পারলো সে!!” আমার কন্ঠে উষ্মা।‘ ভাইয়া, সে যে আমার কাছ থেকে মুক্তি চায় সেটা আমি বুঝতে পারলে তো এম্নিতেই আমি ওর কাছ থেকে সরে আসতাম, এতদূর এগিয়ে যাওয়ার পর এভাবে পালানোর কোন কারন আমি খুঁজে পেলাম না’ ফারিয়া চোখ মুছতে মুছতে বলল। ইশ, আজ একের পর এক চাপ যাচ্ছে মনের উপর দিয়ে। ফারিয়াকে রিল্যাক্স করার দরকার। আমি সহজ গলায় বললাম- আল্লাহ যা করেন ভালর জন্য ই করেন, আমার মনে হয় এই সম্পর্ক ভাল কিছু বয়ে আনতো না, তুমি মন খারাপ করো না, নিশ্চয়ই তুমি আরো অনেক ভাল কাউকে ডিসার্ভ করো।
‘ফারিয়া শুধু শুকনো হাসি দিয়ে বলল- আচ্ছা ভাইয়া আপনি স্যারকে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। ‘করেছি ফারিয়া, বাবা এড়িয়ে গেছেন। অ্যার এখনো তো সে খুব ই অসুস্থ, অপ্রিয় কিছু বললেই আরো অসুস্থ হয়ে যান’ও ভাইয়া আরেকটা জিনিস জানেন আমাদের কোম্পানির একক মালিক কিন্তু আপনি, স্যারের কোন শেয়ার নাই। আপনার মাকে শুধু একটা নির্দিষ্ট শেয়ার দেয়া হয় প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা হিসাবে।আল্লাহই জানে আমার অ্যার কী কী জানতে হবে, আমি ফারিয়াকে বললাম, ব্যাংক ডিটেলস থেকে নানার ডিটেইল ঠিকানা বের করতে। ফারিয়ার মুখ এবার উজ্জ্বল হলো।
স্যার ইনশাল্লাহ কাল পেয়ে যাবেন।আমরা অফিসে ফিরে কোম্পানির অন্যান্য পেপার গুলো চেক করলাম। তেমন গুরুত্বপূর্ন নতুন কোন তথ্য পেলাম না, বরং ফারিয়া যা জানিয়েছে মোটামুটি তাই। আমার ভীষন ক্লান্ত লাগছিল। ফারিয়াকে বললাম- আজ থাক কাল আবার কাজ শুরু করব। ফারিয়া বলল- ভাইয়া এখন কী বাসায় যাবেন? আমি বললাম না, বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছেনা এখন। আমাদের কেয়ার টেকারের ছেলে কে দেখতে হাসপাতালে যাবো ভাবছি।‘ভাইয়া আমি আসি আপনার সাথে? বাসায় যেতে আমারো ইচ্ছা করছে না’।‘ভেবে যেন রাজি হয়ে গেলাম আমি’। ‘আচ্ছা চলো’হাসপাতালে সাব্বিরের কেবিনের বেশ আগে থেকেই সাব্বিরের হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা গিয়ে দেখি কনা এসেছে সাব্বিরকে দেখতে, গল্প জমে উঠেছে।
আমার সাথে ফারিয়াকে দেখে কনা খুব অপ্রস্তুত হলো, হয়তো ভেবেছে এই সেই মেয়ে যার সাথে আমার প্রেম। আমি সেটা ভেবে একধরনের রিল্যাক্স বোধ করতে থাকলাম, যাক তাহলে কনা আমার কথা এবার বিশ্বাস করে আর কষ্ট পাবেনা। আমাদের দেখে কনা দ্রুতই রাত হবার অজুহাতে বেরিয়ে গেল। সাব্বির কে দেখলাম কনাকে তুমি তুমি করে বলছে। আমার ভাল লাগলো। মনে হলো প্ল্যানের কাছাকাছি পৌছে গেছি।
বাবার সাথে কঠিন লড়াইয়ের আগে কনা আর সাব্বিরকে নিয়ে করা প্ল্যান টা এক্সিকিউট করা দরকার। কনাকে স্যাটেল করা আমার দরকার। সাব্বিরকে কাল সকালেই রিলিজ করে দিবে শুনলাম। ফারিয়াকে বাসায় ড্রপ করে বাসায় ফিরলাম আমি যখন, তখন প্রায় মাঝ রাত। পরদিন সকালে বাবার কাছে গেলাম। বাবা তুমি সারাজীবন আমার ইচ্ছা গুলো প্রাধান্য দিয়েছ, আমার একটা ফেভার করবে প্লিজ!!বাবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, আমি বললাম- আমি চাই বাবা তুমি সাব্বিরের সাথে কনার বিয়ের ব্যাবস্থা করবে। বাবা বললেন উনারা তোমাকে জামাই হিসাবে পছন্দ করেছিলেন, এখন কি সাব্বিরকে মানবেন?‘কেন মানবেন না, তুমি ঠিকই ব্যাবস্থা করবে যাতে তারা এবং কনা মানে, আমার মনে হয়না কনার সাব্বিরকে অপছন্দ’।