আজ ১৭ই ফেব্রুয়ারি, তিমির হননের কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন।
আধুনিক বাংলা কাব্যের পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম একজন হলেন জীবনানন্দ দাশ। কবি জীবনানন্দ দাশের নাম শুনতেই বাঙালির চোখে কবির বর্ণিত নির্মল সবুজ গ্রাম বাংলার অপার সৌন্দর্য, চঞ্চলতা ও প্রশান্তির ভাব মনে জাগ্রত হয়।
কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে, বর্তমানে এই স্থানটি ভৌগলিক ভাবে বাংলাদেশে অবস্থিত ও বরিশাল একটি বৃহত্তর জেলা। তার পিতার নাম সত্যানন্দ দাশ ও মাতার নাম কুসুমকুমারী । তার মা সেই যুগে বিন্দু কবিতা রচনা করে কবি খ্যাতি লাভ করেছিলেন । তার মায়ের বিখ্যাত একটি কবিতা হল “ আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।”
জীবনানন্দ দাশ কবি হিসেবে সমাদৃত ও পরিচিত হলেও তার বাংলা সাহিত্যে সমান অবদান রয়েছে, কবি তার মৃত্যুর পূর্বে ২১ টি জনপ্রিয় উপন্যাস এবং ১২৬ টি ছোট গল্প রচনা করে গেছেন।
মায়ের সাহিত্য প্রতিভাই জীবনানন্দকে সাহিত্য সৃষ্টি সাধনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলো। তার কাব্য প্রতিভা মূলত বিকাশ লাভ করেছিলো মায়েরই প্রযত্নে ও উৎসাহে। মায়ের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন এক গভীর অনুভূতি যা তার গলায় ব্রাহ্মসঙ্গীতের মধ্যে ফুটে উঠত।
জীবনানন্দের বাল্যকালে অনাবিল আনন্দ ও প্রীতময় পরিবেশে প্রথম শিক্ষা শুরু হয়। তারই ফলে বাল্যবয়স থেকেই রূপময় প্রকৃতির প্রতি তাঁর কবিমন আকৃষ্ট হয়েছিল। সেই ভোরের নির্মল আকাশ , শিশির ভেজা ঘাস , ধানের ক্ষেতে বয়ে যাওয়া উদ্দাম হাওয়ার মাতন , সেই নদীর চরের চিল – ডাকা বিষগ্ন দুপুর , জলে ভাসা নৌকোর তন্ময় গলুই সবকিছু , বলা যায় প্রকৃতির সমস্ত বর্ণ , বৈচিত্র্য জীবনানন্দের কাছে এক অজানা সুদূরের হাতছানি হয়ে ধরা দিত।
ছেলেবেলায় অনেক সহচরদের কাছ থেকে তিনি নানা গাছগাছালির নাম শুনেছিলেন এবং এরই সাথে পরিচিত হয়েছিলেন নানা লতাপাতা ও পাখির সঙ্গে। তার পরবর্তীকালের কবিতায় এ সমস্ত কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায়। জীবনানন্দ কবিতা উৎস পরিচিত বিচার করতে গিয়ে যে সমস্ত উপাদানের উল্লেখ করেছেন তাতে তার শৈশব ও কৈশোরে প্রাকৃতিক এবং কবি মানসের বিচরণক্ষেত্র স্পষ্টভাবে ধরা পরেছে।
১৯২২ খ্রীঃ তিনি সিটি কলেজের অধ্যাপনা শুরু করেন এবং ঝড়া পালক কাব্যগ্রন্থটি এই সময়ে প্রথম প্রকাশিত হয়।
এছাড়া তিনি কলকাতায় নানা সাহিত্য পত্রিকায় কবিতা রচনা শুরু করেন।তার সমস্ত কবিতাই পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়।
জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক । পরে একে একে প্রকাশিত হয় ধূসর পান্ডুলিপি , সাতটি তারার তিমির , রূপসী বাংলা , মহাপৃথিবী , বেলা অবেলা কাল বেলা প্রভৃতি । তার রচিত বনলতা সন আধুনিককালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ।
জীবনানন্দের কাব্যের ইতিহাস চেতনা , নিঃসঙ্গ বিষন্নতা এবং অবশ্যই বিপন্ন মানবতার ব্যথা তার স্বকীয় বিশিষ্টতা নিয়ে স্থান লাভ করেছিলেন ।
জীবনানন্দের প্রবন্ধ গ্রন্থ কবিতার কথা , জীবনানন্দ দাশের গল্প উপন্যাস ‘মাল্যবান’ ও ‘সতীর্থ’ তার সাহিত্যধারার উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
জীবনানন্দ দাশ সাহিত্য রচনার জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন । ববাহোত্তরকালের একবিশিষ্টকবি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ। বাংলা কাব্য সাহিত্যে তার প্রভাব সর্বাধিক।
বাংলা সাহিত্যে তার প্রথম আবির্ভাবের সময় বহু বিতর্কিত কবি ছিলেন । কারণ তার সব কবিতার উপমা , চিত্রকলা এতই প্রথাবিরোধী ছিলো যে তা রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যের ঐতিহ্যের পথে ছিলো এক বিরাট ব্যাতিক্রম ।
জীবনানন্দের কবিতায় মনন অপেক্ষা আবেগের প্রাধান্য বেশী থাকলেও তার কবিতায় ইতিহাস – ভূগোলে সমন্বিত এক বুদ্ধিদীপ্ত চেতনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় ।
জীবনানন্দের কাব্যের বিষয়বস্তুহল প্রকৃতি ও প্রেম । এই কাব্যকলার অসাধারণ তত্ত্বই তাঁকে বৈচিত্র্য ও গভীরতা দান করেছে । এছাড়াও তার বিভিন্ন গ্রন্থে শিল্পীশৈলী ও বর্ণাঢ্য চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকৃতি ও প্রেমের নানা দিক উদঘাটিত হয়েছে।
আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ এক স্বতন্ত্র কবি। তাঁর কাব্যকলার ক্ষেত্রে এই স্বাতন্ত্রতার জন্যই বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অনন্য। তিনি ছিলেন এক রোমান্টিক কবি। বাল্যবয়স থেকেই রূপময় প্রকৃতির প্রতি তার কবিমন আকৃষ্ট হয়েছিল। ভোরের নির্মল,আকাশ , শিশির ভেজা ঘাস , ধানের ক্ষেতে উদ্দাম হাওয়ার মাতন , নদীর চরের চিল, ডাকা বিষন্ন দুপুর, জলে, ভাসা নৌকোর তময় গলুই, সবকিছু , প্রকৃতির সব বর্ণ- বৈচিত্র্য জীবনানন্দের কাছে এক অজানা সুদূরের হাতছানি হয়ে ধরা দিত ।
এই রূপমুগ্ধ কবির কণ্ঠে তাই আমরা শুনতে পেয়েছিলাম –
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।”