
মানুষের জীবন আসলে খুবই অদ্ভুত আর প্রবাহমান। বাবার রুমে মাঝরাতে আমি যখন ঢুকলাম, তখন প্রায় রাত তিনটা, জেট ল্যাগের কারনে আমার ঘুম আসছিল না। ভেজানো দরজায় আমি কোন প্রকার শব্দ না করেই প্রবেশ করার চেষ্টা করতে গিয়ে দরজার পাশে রাখা সাইড টেবিলের সাথে পা লেগে পড়তে পড়তে বেঁচে গেলাম ঠিকই কিন্তু প্রচন্ড জোরে শব্দ করে একটা গ্লাস পড়ে গেলো। আমি ভয় পেলাম বাবা হয়তো উঠে বসবে, কিন্তু আমাকে প্রায় দুনিয়ার অষ্টম আশ্চর্যের হতবিহবলতায় অবাক করে দিয়ে বাবার পাশ থেকে উঠে বসলেন রেহানা আন্টি!! ডিম লাইটের আবছা আলোতেও আমি তার ভয়, বিস্ময় আর হতাশ মুখ এক সাথে আবিষ্কার করলাম। আর আমি? অবাক, দুঃখ বা হতাশা কিছু নয় বরং আমি শুধু নিঃশব্দে লাইট টা জ্বলালাম। রেহানা আন্টি, আমাকে বলতে গেলো- অয়ন বাবা, আসলে তোমার বাবার শরীর খারাপ তাই আমি …
আমি নিজের তর্জনী ঠোঁটের উপর রেখে তাকে চুপ করতে বললাম। আর খুব আস্তে বললাম আপনি প্লিজ আমার সাথে ডাইনিং এ আসুন। বাবা ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ঘুমাচ্ছে আমি বুঝতে পেরে আমি রেহানা আন্টি কে ডাইনিং এ নিয়ে সব জানতে চাইলাম। রেহানা আন্টিও আমার নির্দেশ মেনে ধরা পড়া চোরের মত মাথা নিচু করে ডাইনিং এ আসতে লাগলেন আমার পিছু পিছু। বাবার রুমের লাইট অফ করে আমরা ডাইনিং এর দিকে গেলাম।
ডাইনিং টেবিলে আমি তার মুখোমুখি বসে বললাম- দেখুন আমি সত্য জানতে চাই, এখন আমার বাবা যখন প্রায় মৃত্যু শয্যায়, আশা করি আপনি আমাকে সব সত্য বলবেন। অথবা আমি এই বাড়ি আর সব ছেড়ে চিরদিনের মত কোথাও চলে যাব। আমার মনে তখন বৈশাখের ঘুর্নিঝড়, রাগ আর কষ্ট একসাথে ঘুরপাক খাচ্ছে, সারাজীবন আমার যে বাবা কে আমি সন্ত পুরুষ জেনে এসেছি তার এহেন পদস্খল আমার সহ্য হচ্ছেনা। কী তীব্র বেদনাই না আমি অনুভব করছিলাম সে মুহুর্তে। আমার নিজেকে রিক্ত আর প্রতারিত মনে হচ্ছিল,
রেহানা আন্টি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে শুরু করলেন- অয়ন, আজ যে সত্যের মুখোমুখি তুমি দাড়াতে যাচ্ছ, তা আসলে কারোর জন্যই মঙ্গগল হবে না, আমার মনে হয় তাই তোমার সেটা না শোনাই সব চেয়ে ভাল। শুধু এটুকুই বিশ্বাস রেখো তুমি যা দেখেছে, তাতে কোন পাপ নেই, তাতে কোন অন্যায় নেই।
আমি জেদীর মত উনাকে বললাম- দেখুন আমি ভাবাবেগের কথা শুনতে নই আমি সত্য জানতে চাচ্ছি। আপনি আমার বাবার রক্ষিতা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমি পুরোটাই জানতে চাই” দাঁতে দাঁত চেপে বললাম।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেহানা আন্টি বলতে শুরু করলেন- ছিঃ অয়ন! আমাকে নোংরা ভাবছ ঠিক আছে, বাবাকে না। তোমার বাবা তার সমস্ত জীবনের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়েছেন শুধুমাত্র তোমাকে একটা সুস্থ জীবন দেয়ার জন্য।
আমি ক্রূর হাসি দিয়ে বললাম, এখন কী আমাকে নিয়ে ইমোশনাল গেইম খেলে নিজেকে আড়াল করতে চাইছেন!! শোনেন আমি ভালই বুঝতে পারছি আমার বাবার একাকীত্বের সুযোগে আর সম্পদের লোভে নিজের হীন চরিত্রে বাবাকে বশ করেছেন গত ছয়মাসে!!
এইবার হেসে ফেললেন রেহানা আন্টী- অয়ন তুমি যা ভাবছ, বিষয়টা তার চেয়েও জটিল। আমি তোমার বাবার বিবাহিতা স্ত্রী, আর সেও ত্রিশ বছর ধরে।
ত্রিশ বছর!!! আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, তাহলে আমার মা!
অয়ন বাবা, শোন প্লিজ, তুমি একটু ঠান্ডা মাথায় আমার কথা গুলো শোন। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে, আজ আমি তোমাকে যা বলবো তা কেবলমাত্র তোমার বা আমার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং তোমার বাবা কখনোই যেন বুঝতে না পারেন তুমি আমার কাছ থেকে সব জেনেছ, ইনফ্যাক্ট যেন কেউই বুঝতে না পারেন যে তুমি কিছু জানো।
আমি তখন ক্ষোভ আর কৌতুহলে এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে তার সব শর্তেই রাজি হয়ে গেলাম। উনি বলতে শুরু করলেন-
তোমার বাবা ছিলেন এক শিক্ষকের ঘরের সন্তান, ছোটবেলায় মাকে হারান, তোমার দাদা পাগল হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন, অনেক পরে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল কোন এক মর্গে। সে গল্প অন্য একদিন বলব। তোমার অসহায় এতিম বাবাকে আমার মা নিজ সন্তানের স্নেহে বড় করবেন বলে আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন। ও বলা হয়নি, আমি আর তোমার বাবা কাজিন। আমার মা ছিলেন তোমার বাবার ফুপু। আম্মাকে তোমার বাবাকে নিয়ে এলেন আমাদের বাসায়। আমাদের বাসায় যখন সে আসলো, তখন আমার বাবা এলাকার চেয়ারম্যান এবং ব্যাবসায়ী। এলাকার অন্যতম সেরা ধনী পরিবারের সন্তান ছিলাম আমরা। আমরা মানে আমি আর আমার তিন বোন। আমাদের কোন ভাই ছিল না। তোমার বাবাকে আমার মা নিজ সন্তানের স্নেহে বড় করলেও আমার বাবা তাকে দুইচোখে দেখতে পারতো না। কারনে অকারনে মারতো। অসহায়, এতিম একটা ছেলের প্রতি আমার বাবার এমন সীমাহীন আক্রোশ কখনোই আমি বা আমার বোনেরা মানতে পারতাম না। তাকে আমরা সবাই খুব খুব ভালবাসতাম। আমি ছিলাম সবার ছোট, তোমার বাবার সমবয়সী। আমার বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল অনেক ছোটবেলায়, উনি স্বামীর সাথে সেই বয়সেই ইউ এস এ পাড়ি জমান। এক সময় উনার সাথে আমাদের সবার যোগাযোগ কোন অদৃশ্য কারনে বন্ধ হয়ে যায়, সম্ভবত উনার উন্নাসিক স্বামী আমাদের সাথে উনাকে আর যোগাযোগ রাখতে দেন নি। যাই হোক, যখনকার কথা বলছি, আমার মেজ বোনের ও বিয়ে হয়ে গেছে। আমি আর তোমার বাবা একই ক্লাসে পড়তাম। ভীষন ভাল ছাত্র ছিল তোমার বাবা। সে বছর আমি এবং সে দুজনেই এক সাথে ট্যলেন্টপুলে বৃত্তি পেলাম ক্লাস ফাইভে। পুরো গ্রামে আমাদের নিয়ে মাতামাতি, অনেক সংবর্ধনা দেয়া হলো। আমার বাবা সেই প্রথন তোমার বাবাকে নিজে থেকে একটা শার্ট কিনে দিলেন। আমার এত ভাল লাগছিল, আমি কেঁদে ফেললাম, দেখলাম তোমার বাবাও কাঁদছে। আচ্ছা অয়ন তুমি কী জানো তোমার বাবা যে খুব সুন্দর একটা ডাক নাম আছে??
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তে তাকালাম রেহানা আন্টির দিকে।
তোমার বাবার ডাক নাম টগর। তোমার দাদা রেখেছিলেন সে নাম। জীবনে আমার মা, আমি আর বোনেরা ছাড়া কেউ কখনো সে নামে ডেকেছিলেন কিনা জানা নেই। আজ আমি তোমাকে টগরের গল্প বলব।
টগর ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, যদিও আমার বোনেরা তাকে ভাই ভাবতেই খুব পছন্দ করতো। কিন্তু আমার শৈশবের প্রায় পুরোটা জুড়েই ছিল টগর। টগর খুব সুন্দর ছবি আকতে পারতো। একবার তখন আমরা ক্লাস এইটে পড়ি, জাতীয় পর্যায়ের কোন এক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় দেশ সেরা হলো টগর। পুরষ্কার দিবেন ততকালীন প্রেসিডেন্ট। তার কিছুদিন পর আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা। টগরকে ঢাকায় নিয়ে যাবার কেউ নেই, পুরষ্কার আনতে যাবে কেই নেই তার সাথে। আমাদের স্কুলের এক স্যার গেলেন সাথে। বাবা কিছুতেই খরচ দিবেন না, এইসব ছবি আকাআকি তার কাছে অর্থহীন চর্চা। মা লুকিয়ে আমার মেজ বোনকে দিয়ে টাকা পাঠালেন স্যারের কাছে টগর কে ঢাকায় নিয়ে যাবার খরচ। টগর আর স্যার দুই দিনের জন্য ঢাকা গেলেন। প্রতিটা জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হলো তোমার বাবার ছবি। আমাদের গ্রামে তখন পত্রিকা আসতো সন্ধ্যার দিকে। হেড মাস্টার ছুটতে ছুটতে আসল টগরের ছবি সহ পত্রিকা নিয়ে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল টগর আমাদের কোন অংশ নয়, টগর বিরাট কোন ব্যাক্তিত্ব। আর টগর, কী ভীষন লাজুক ছিল, রাতের আগে তাকে আর খুজেই পাওয়া গেল না। তার কিছুদিন পর জানা গেলো টগরকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সাথে ইন্ডিয়া পাঠাবে বাংলাদেশ সরকার। টগরের গর্বে ভরে গেলো আমার মায়ের বুক। নিজের জমানো টাকায় নতুন নতুন সব শার্ট বানিয়ে দিলেন, পনের দিনের জন্য টগর চলে গেলো ইন্ডিয়া। টগর গেলো ১৫ দিনের জন্য। আমাদের বয়স তখন ১৪। শৈশব ছেড়ে কৈশোরে মাত্র প্রবেশ করেছি আমি। টগর কে না দেখে ১৫ দিন থাকা আমার কাছে দুর্বিষহ লাগতে লাগলো। আমি বুঝে গেলাম, আমি টগরের প্রেমে পড়েছি। কী ভীষন লজ্জা আর ভয় হতে থাকলো আমার। আমার মনে হচ্ছিল যে কেউ আমাকে দেখলেই বুঝে ফেলবে আমি টগরের প্রেমে পড়েছি। ঐ ১৫ দিন যে আমার কী করে কাটলো বোঝানো যাবেনা।
টগর ফিরলে আমার মনে হলো আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। টগর তখন অনেক কনফিডেন্ট একজন কিশোর। ১৫ দিনের বিদেশ সফর ওকে অনেক বদলে দিয়েছে, সরকারের কাছ থেকে পাওয়া টাকায় সে আম্মার জন্য শাড়ি আর আব্বার জন্য ঘড়ি আনলো। আমার বোনদের জন্য এনেছিল চুলের ক্লিপ। আমরা সবাই খুব খুশি হলাম। আমাকে খুব অবাক করে দিয়ে সে আমাকে একটা লাল নোট বুক গিফট করলো, তাও সবার চোখের আড়ালে। আমি খুশি আর বিস্মইয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সে রাতে টগর জানালো সে ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করতে চাচ্ছে। সেই প্রথম আমার বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখলাম সদ্য কচি দাড়ি গোফ গজানো টগরকে। কী সাবলীল আর আত্মবিশ্বাসী লাগছিল টগর কে। সে জানালো সরকারি অর্থ সহায়তায় সে ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা করতে চায়, বিদেশি একটি সংস্থা তাকে ফান্ডিং দিবে। টগরের বলার মাঝে এমন একটা কিছু ছিল যে বাবা না বলার কোন সুযোগ ই পেলেন না। আম্মা শুধু কেপে গিয়ে বলল, তুই একা কী করে থাকবি বাবা? ফুপু আম্মা, আমি তো সবসময়ই একা। টগরের এই কথা শুনে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলেন আম্মা। আর আমি- কী প্রচন্ড কষ্ট যে আমার হচ্ছিল, এক গাদা কান্না দলা পাকিয়ে আমার গলার কাছে এসে ঠেকলো। আমার মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় দম আটকে মারাই যাবো। আমি সারারাত নির্ঘুম কাদলাম। আম্মা আমার ফোলা চোখ দেখে বুঝলেন টগরের জন্যই আমার কান্না। আম্মা শুধু বললেন- রিনা, টগর কে বাঁধা যাবেনা রে,ও যে অজেয়। ও তোমাকে বলা হয়নি, আমার ডাক নাম রিনা। মায়ের ঐ কথায় আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম। তাহলে কী টগর চিরদিনের মত আমার কাছ থেকে দুরে সরে যাবে!!
টগরের ঢাকায় যাওয়াট আমার জন্য বলতে গেলে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিল, যে কথা কখনোই আমি হয়ত মুখ ফুটে বলতে পারতাম না, চিঠি লিখে জানাতে আমার খুব একটা সময় লাগলো না, চিঠি দেয়া নেয়া আর বছরের দুই ঈদে টগর বাড়ী আসার মধ্যে দিয়ে আমরা আরো বেশি কাছাকাছি চলে এলাম। এস এস সিতে টগরের রেজাল্ট খুব একটা ভাল না হলেও আমি দুর্দান্ত রেজাল্ট করলাম। এবার মা চাইলেন আমি যেন ঢাকায় পড়তে যাই, বাবাকে রাজি করাতে পারলাম না তবে, আমাকে কথা দিলেন এইচ এস সির পর আমি অবশ্যই ঢাকা গিয়েই পড়বো। এইচ এস সি পরীক্ষার ২ মাস আগের কথা ,এক লঞ্চ দূর্ঘটনার আমার বাবা আর বোন মারা যায়। এই ঘটনায় পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে আম্মা। আমিও কিছুতেই আর মনোযোগ দিতে পারছিলাম না, টগর এসে থাকলো কিছুদিন। এরপর আমাদের পরীক্ষা, আমার রেজাল্ট এতটাই খারাপ হলো যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াও হলো না। আর মাকে রেখে ঢাকায় পড়তে যাওয়াও আমার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়লো। আমি স্থানীয় এই কলেজে বি এ তে ভর্তি হলাম। আব্বার ব্যাবসার কিছুই আমরা জানতাম না। আম্মার মানসিক অবস্থাও তখন খুব খারাপ ছিল, আম্মাও সব কিছু গোছাতে পারছিলেন না। কোন ভাবে আমাদের দিন চলছিল। টগর তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র। আমার সাথে তার চিঠি লেখালেখি টা বেশ বেড়েছে তখন, আমার তো তখন টগর ছাড়া কেউ ই নেই। আমরা খুব অর্থকষ্টে পড়ে গেলাম, আমার চাচারা ঘোষনা করলো যে আমাদের বাবার কোন ছেলে না থাকায় আসলে আমরা তেমন কোন বিষয় সম্পত্তি পাবোনা। তবুও তারা তাদের মহত্ত্ব দেখাতে আমাদের কোন রকম খাওয়া পড়ার ব্যাবস্থা করলো। আর আম্মাকে চাপ দিচ্ছিল আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়ার জন্য। তখন টগর মাত্র থার্ড ইয়ারে পড়ে, ওকে বিয়ের কথা বলাটাও আমার কাছে খুব লজ্জার। তবু একবার ঈদে সে বাসায় আসলে আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম- টগর আমি আর পারছিনা, চাচার আমাকে বিয়ে দিবেন ই। টগর হাসতে হাসতে বলল চল তাহলে বিয়ে করে ফেলি। আমি অবাক হয়ে তাকালাম, সে কাছে এসে বলল আমি সিরিয়াস। তবে তোমার উপযুক্ত হতে আমাকে দুইটা বছর সময় দিতে হবে। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন। তার ও প্রায় বছর খানেকপর মেজ আপার বাসায় যাবার নাম করে আমরা খুব বেড়ালাম, সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার আগে টগর কি মনে করে যেন আমাকে বলল, রিনা বিয়ে করবে আমায়?্টগরের কণ্ঠে এমন কিছু একটা ছিল যে আমিও রাজি হয়ে গেলাম। সেদিন সন্ধ্যায় কাজি অফিসে গিয়ে বাড়ী ফিরে এলাম আমরা। ওর হাত ধরে যখন ফিরছিলাম, কী অদ্ভুত একটা অধিকার বোধ হচ্ছিল। টগর বলল আর মাস ছয়েক পরেই ওর ফাইনাল পরীক্ষা, পরীক্ষা দিয়ে এসেই আম্মাকে বলে সব ব্যাবস্থা করবে। টগরের ঢাকায় যাবার তাড়া ছিল পরদিন ভোরে সে চলে গেলো।
আমার মন পড়ে থাকলো টগরের কাছে, আমি বারেবার ওকে বাড়ি আসার তাড়া দিচ্ছিলাম, কিন্তু পরীক্ষার ব্যাস্ততায় ও সময় করতে পারছিলনা, আমার চাচাদের উতপাত বেড়েই চলল। আমাদের কিছু বড় গাছ ছিল সেগুলো আম্মাকে না জানিয়েই বিক্রি করে দিলেন। আম্মাকে চাপ দিচ্ছিলেন তাদের পছন্দ করা এক লোকের সাথে বিয়ের জন্য। আমার একদম দম বন্ধ হয়ে আসছিল, এমনই এক রাতে আমাকে অবাক করে দিয়ে টগর এসে হাজির। আম্মার শরীর টা সেদিন খুব খারাপ ছিল, আমি টগর কে ভাত বেড়ে খাওয়ালাম। সে হেসে বলল, এই তো আমার বউইয়ের মত লাগছে। আমি ভীষন লজ্জা পেলাম। সেদিন রাত আমার জীবনের সেরা রাত ছিল। বিবাহিত জীবনের পুর্নতা পেল সে রাতে। খুব খুব সুখে কাটলো আমাদের সে রাতে। পরের সপ্তাহে টগরের ফাইনাল, তাই আম্মার দোয়া নিয়ে পরদিনই চলে গেলো টগর।
টগর চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন আম্মা। বিভিন্ন কৌশলে আমাকে ভয় দেখাতে লাগলো, আমি অনেকবার টগরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু চাচাদের বাধায় আর ওর পর্যন্ত পৌছানো হল না আমার। আম্মার মৃত্যুর পরদিন ই একপ্রকার বেধেই আমার বিয়ে দেয়া হয় হাসেমের সাথে। স্বল্প শিক্ষিত হাসেম আমাদের গ্রামের ই ছেলে কিছুটা বোকা আর উদাসীন দরিদ্র পরিবারের সে খুব বেশিদুর লেখাপড়াও করেনি। আমার মেজ বোন কে আম্মার লাশ ও দেখতে দেয়া হয়নাই। আমি টগরের কথা অনেকবার সবাইকে বলতে চাইলেও কেউই আমার কথা শুনলো না। একদিকে মায়ের জন্য শোক অন্যদিকে টগরকে হারিয়ে ফেলা আমি পাগল প্রায়। হাসেমকে বিয়ের রাতে আমি পা ধরে অনুরোধ করি তাকে জানাই টগরের কথা। বোকা হাসেম বলে ঠিক হয়ে যাবে, টগর ঢাকা শহরে পড়ে তোর কাছে কি আর আসবে??
মায়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে টগর গ্রামে আসার অনেক চেষ্টা করে কিন্তু আমার চাচারা মিথ্যা খবর দেয় যে আমি হাসেমের সাথে পালিয়ে গেছি শুনে মা মারা গেছে, টগর অবশ্য বিশ্বাস করেনি প্রথমে, কিন্তু আমার অতি ধুরন্ধর চাচারা পরিস্থিতি এতটাই ঘোলাটে করে যে টগর আর গ্রামেও আসতে পারেনা, আমার সাথে দেখাও করতে পারেনা। আমিও এমন ট্রমায় পড়ে গিয়েছিলাম। টগরের সাথে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। যখন যোগাযোগ করতে পারলাম জানলাম তোমার মা কে বিয়ে করে সে দেশের বাইরে গেছে পড়াশোনার জন্য। আমি একদম ভেঙ্গে পড়লাম। এর মাঝেই সাব্বির এলো আমার গর্ভে। হাসেমের সাথে আমার কখনোই বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না, আর তাই বুঝতেই পারছো সাব্বির তোমার পিতারই সন্তান।
যে অনুচ্চারিত ভয় আমি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছি সাব্বিরের ব্যাপারে, আজ তার মুখোমুখি আমি। কী তীব্র হাহাকার আমি বোধ করছি, সাব্বির আমার ভাই, একই পিতার ঔরসে জন্মানো ভাই আমার। এমন এক অদৃশ্য সম্ভাবনার ভয় যে আমার মাঝে ছিল না তা না, কিন্তু বরাবরই উড়িয়ে দিতে চাইতাম আমার সেই সন্দেহ করা ভয়। উফফ আজ তাহলে এই অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি আমি!! তাহলে আমার মা ??