
দেশে ফিরলাম আমি ৬ মাস ১৯ দিন পর। গত ছয়মাস আমার জীবন ছিল নিস্তরঙ্গ বন্ধুহীন। আমার স্কুল জীবনের কিছু বন্ধুদের খুঁজে বের করার কথা আমি অনেকবার ভেবেছি। কিন্তু এক আজীবন বয়ে বেড়ানো ভয় আর সংকোচ আমাকে সে পথে যেতে দিল না। এর মাঝে মার্গারেট নামে আমার এক শিক্ষিকার সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়, মার্গারেট কে দেখলেই কেন যেন আমার মনে হত আমার মা হয়ত এমন ই ছিলেন। মার্গারেটের বয়স ৫০ এর আশে পাশে। নীল চোখ আর ব্লন্ড চুলের মার্গারেটের হাসিটা ছিল আমার মায়ের পোট্রেটের মত, আমি কী আমার মায়ের জন্য বুভুক্ষ ছিলাম। আমার বিষয় ছিল ‘ ম্যাগ্নেটিক রিসোনেন্স এন্ড হাইপার পোলারাইজেশান’ আর মার্গারেট ছিলেন আমাদের একডেমিক কাউন্সেলর, তার বিষয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজী, আমি কারনে অকারনে তার চেম্বারে যেতাম, একটা সময় সে ও বুঝে ফেলল আমি নিছক গল্প করতেই তার কাছে যাই।
মার্গারেট আমার শৈশব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতো, একদিন সে আমাকে বলে- ‘আচ্ছা, তোমার মা কিভাবে মারা গেলেন?’ আমি বাবার বুলি যেন আওড়ে গেলাম আমার মুখ দিয়ে- আমার জন্মের পর পর মায়ের ইন্টারনাল বিল্ডিং হতে থাকে, মায়ের রক্তের গ্রুপ খুব রেয়ার ছিল, এনাফ পরিমান রক্ত ও দেয়া যায় নাই, আরো কিছু জটিলতায় মারা যান মা’ মার্গারেট অনেক্ষণ চুপ থেকে বললেন- আচ্ছা অয়ন, তুমি তোমার মায়ের গ্রেভে গেছ কখনো? আমি বললাম না, বাবা চাইতেন না আমি মায়ের কবরে যাই, আমি হাসেম মামা কে অনেকবার বলেছি, উনি বরাবর ই এড়িয়ে গেছেন। মার্গারেট বলল- অয়ন এখন তো তুমি অনেক বড়ো হয়েছ, এবার দেশে গিয়ে তোমার মায়ের কবর খুঁজে বের করে কিছুক্ষণ পাশে বসো তো, আমার মনে হয় তুমি শান্তি পাবে। মার্গারেটের এই কথা শোনার পর, আমার তক্ষুনি ইচ্ছা করছিল, মায়ের কবর খুঁজে বের করে কিছুক্ষণ পাশে বসতে, নিজেকে এত ছোট মনে হচ্ছিল, আসিফ মারা যাবার পর আমি প্রায়ই তার কবরের পাশে বসে কেঁদেছি, আল্লাহর কাছে দোয়া ও করেছি, মায়ের কবর না খোজার জন্য কখনো চেষ্টা করলাম না কেন।
আমি যখন ছোট, বাবা বাসায় এক মৌলভী রেখেছিলেন কোরআন শিক্ষার জন্য, আমাকে ভীষন স্নেহ করতেন মৌলভী চাচা। আমার মা ছিল না বলে আমার জন্য তার প্রগাড় সমবেদনা ছিল, উনি আমাকে মহানবী (সঃ) এর জীবনী শোনাতেন, বলতেন বাবা আমাদের নবী(সঃ) এর ও তো মা ছিল না। তুমি মন খারাপ করো না, আমি উনাকে যতই বলতাম যে আমার মন খারাপ না, উনি ভাবতেন আমি মিথ্যা বলছি। উনি আমাকে অনেক দোয়া শেখাতেন মায়ের জন্য। আমাকে উনি বললেন আমি যেন মায়ের কবরের পাশে বসে ইয়াসীন সুরা নিয়মিত পড়ি। আমি বাবাকে এই কথা বলার পর বাবা গম্ভীর গলায় বলেছিলেন তুমি বাসায় বসেই পড়ো, তোমার মা হয়ত শান্তি পাবেন। আমি মায়ের কবর দেখার জন্য কিছুদিন বাবার সাথে ঘ্যান ঘ্যান করলাম, বাব শুনেও না শোনার ভাল করে রইলেন। এর কিছুদিন পর ই বাবা আর মৌলভী চাচাকে বাসায় আসতে না করে দেন।
মার্গারেট আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, পঁচিশ বছর বয়সেও আমি কেন সিঙ্গেল! আমি হেসে বললাম, মেয়েরা আমাকে পছন্দ করে না হয়তো। মার্গারেট আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, আসলেই কি তাই, নাকি তোমার ই মেয়েদের কে পছন্দ করার সাহস নাই। আমি কিছুটা হাসার ভান করে বললাম, নো ওয়ে মার্গারেট, আমার বাবার পছন্দের মেয়েকেই আমার হয়ত বেছে নিতে হবে। মার্গারেট বলল, আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করে তোমার মত হ্যান্ডসামকে কে পায়, আমিও মার্গারেট কে বললাম- আমি তোমাকে আগেই ছবি পাঠাবো। সেদিন ই বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে, খুব দ্রুত সব গুছিয়ে আমাকে চলে আসতে হয়।
দেশে ফিরলাম আমি, আমাকে হতবাক করে দিয়ে আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসলো সাব্বির। সাব্বির আর আমি একই বিল্ডিং এ বড় হয়েছি, বলা যায় একই খাবার খেয়ে বড় হয়েছি, এমনকি অনেকেই বলেন আমরা দেখতেও নাকি অনেক টা এক রকম, সেই সাব্বিরের সাথে আমার কোন রকম মানসিক যোগাযোগ কখনো গড়ে উঠেনি, অথচ ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হওইয়াটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ছিল। আমার চেয়ে মাস দুইয়েকের বড় সাব্বির, আমার চেয়ে লম্বায় ইঞ্চি খানেক ছোটই হবে। অত্যন্ত সুপুরুষ সে, আমার সৌন্দর্যের কমনীয়তাটা তার মাঝে নাই একদম, গ্রীক যুবকদের মত কিছুটতা তোবড়ানো গাল পেয়েছে সে মায়ের কাছ থেকে, আর হাল ফ্যাশানের খোঁচাখোঁচা দাড়িতে তাকে অপূর্ব লাগছিল, সে আমাকে কখনোই কিছু বলে সম্মোধন করেনি। ছোটবেলায় অনেকবার আমাকে ভাইয়া ডাকার ট্রাই করে বেদম মার খেয়েছে সে হাসেম মামার কাছে। হাসেম মামার মতো মাঝারি গড়নের কিছুই সে পায় নি, বরং তার মায়ের চোখ ঝলসানো রঙ সে পেয়েছে। সাব্বিরকে যথেষ্ট স্নেহ করতো আমার বাবা, আমার বাবার নাক উচু স্বভাব সত্ত্বেও সাব্বিরকে সে ভাল স্কুল কলেজেও পড়িয়েছে। সাব্বিরের রেজাল্ট যথেষ্ট ভাল থাকার পরেও কোন এক বিচিত্র কারনে তার লেখা পড়া আর বেশিদূর আগায় নি, শুনেছি কোন এক কলেজ থেকে সে পাস কোর্সে বি এ পাস করেছে।
সাব্বিরকে আমার সাথে মিশতে না দিলেও সাব্বির আমার বাবাকে ডাকতো বড় বাবা, খুব ছোট বেলায় বাবা এই ডাকটা পছন্দ করতো না, রাগ হয়ে যেত স্যার বলতে ফোর্স করত। তারপর কিভাবে যেন অদৃশ্য বলে মেনে ও নিল বাবা। সাব্বির কে বাবা চাইলেই আমাদের অফিসে চাকরি দিতে পারতো কিন্তু তা না করে তাকে দোকান দিয়ে দিয়েছিল বলে আমি শুনেছি। আজ দেখছি বাবার পার্সোনাল গাড়ি ড্রাইভ করছে সাব্বির। বাবা কী তাহলে তাকে ড্রাইভার হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে?? আমি হাসিমুখে সাব্বিরের দিকে এগিয়ে গেলাম, সাব্বির এগিয়ে এসে আমার লাগেজ গাড়িতে তুলল। আমি ড্রাইভিং সিটের পাশে বসতে চাইলে সাব্বির বলল, স্যার আপনি পেছনে বসেন, বড় বাবা রাগ করবেন। আমি অনিচ্ছা স্বত্তেও পেছনের সিটে বসলাম। পুরো রাস্তায় আমি বাবার অনেক কথা খুঁটিয়ে জানতে চাইলাম সাব্বিরের কাছে, কিন্তু সাব্বির রোবটিক ভাবে হ্যাঁ, না জাতীয় উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল। বাসায় ফিরে দেখলাম বাবা ঘুমাচ্ছে, হাসেম মামা আমার রুম রেডি করে রেখেছিলেন, আমি শাওয়ার নিয়ে লাঞ্চ করলাম, বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমে দু’চোখ বুজে আসলো।
দীর্ঘ ১৮ ঘন্টার নির্ঘুম যাত্রায় ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।
আমার যখন ঘুম ভাংলো তখন বাংলাদেশ সময় রাত প্রায় দশ টা। আমি ফ্রেশ হয়ে বাবার ঘরে উঁকি দিলাম, দেখলাম বাবা রাতের খাবার খাচ্ছেন বিছানায় বসে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাব্বিরের মা রেহানা আন্টি। খুবই আনিউজুয়াল একটা দৃশ্য, আমার সদা কেতা দুরস্থ বাবা ডাইনিং ছাড়া কখনো খান না আজ এভাবে বেড রুমে খাচ্ছেন, তার অর্থ হয়ত বাবা খুব বেশি অসুস্থ। আর বড় হবার পর এই প্রথম আমাদের ফ্ল্যাটে রেহানা আন্টির উপস্থিতি আমার খুব ই খাপ ছাড়া লাগলো। কিন্তু বাবাকে দেখলাম খুব স্বাভাবিক। বাবা আমাকে দেখে হাসার চেষ্টা করলেন, চেহারা দেখেই তার অসুস্থতার তীব্রতা আন্দাজ করতে পারলাম, দ্রুত পায়ে কাছে গেলাম আমি। বাবা বললেন হাটতে পারিনা অয়ন আমি আর বলেই চোখ বেয়ে নেমে আসলো দু’ফোটা অশ্রু।আর আমার বুক ফেটে কান্না আসতে থাকলো বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলাম আমি সেই ছোট্ট বেলার মত। বাবা হাত ও ঠিক মতো নাড়তে পারছেন না। আমার মাথায় তবু হাত বুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। রেহানা আন্টী এগিয়ে এসে বাবার চোখ মুখ মুছে দিল। আর আমাকে এক প্রকার হতবাক করে দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আমার এই জীবনে প্রথম কোন নারী আমাকে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়েছেন। আমি খুবই আপ্লুত হয়ে পড়লাম। আমার আরো কান্না আসতে থাকলো, আমার বাবার জন্য, আমার না দেখা মায়ের জন্য।
মাঝ রাতে ঘুম ভেংগে গেল আমার, যে কাজ আশৈশব আমি করিনি, তা-ই করতে গেলাম। সেদিন রাতে আমি কী মনে করে যেন আমি বাবার সাথে ঘুমাতে আসলাম, পরে মনে হলো না আসলেই ভাল হতো, যে দৃশ্য আমি আমার দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করিনি, আমাকে আজ তা-ই দেখতে হলো, অবশ্য এই ধাক্কাটা আমার জন্য দরকার ছিল, আমার অতি সরল আচরনের পেছনেও যে জানার কোন ফাঁক আছে সেটা বোঝার জন্য হলেও মাঝরাতে বাবার রুমে আসাটা জরুরি ছিল।