অদম্য শিউলি এখন ডাক্তার হওয়ার পথে !!

b7d54109-70af-4189-b0ff-1544afe0a132

ভাতের অভাব থেকে মুক্তির আশায় স্কুলে পড়ার সময় মা–বাবা তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বশুরবাড়িতে ভাতের অভাব ছিল না, কিন্তু সেখানেও তার কান্না থামেনি। বাড়ির বউকে আর পড়াতে চাননি তারা। শিউলির জেদ, তিনি পড়বেন। স্বামীও পড়াবেন। এরপর বাড়িতে শিউলির ভাত বন্ধ হয়ে যায়। না খেয়েই কলেজে যান। প্রতিবাদ করায় স্বামীসহ শিউলিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।

স্বামী সামান্য বেতনে একটি কোম্পানির কাজ করতেন। বাড়ি ভাড়া দিলে আর খাওয়ার কিছু থাকে না। এরই মধ্যে শিউলি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। পড়তে পড়তেই মা হয়েছেন। এসব করেই এবার তিনি বারিন্দ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। সব মিলে শিউলির জীবনটা সিনেমার গল্পের মতো। শেষ দৃশ্যে এসেও চোখের পানি মুছতে হয়। অল্প দিনের জন্য তার বাবা দেখে যেতে পারেননি মেয়ের এ সাফল্য। এ কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন শিউলি।

পুরো নাম শিউলি আক্তার। স্বামী রাশেদুর রহমান। তারা এখন রাজশাহী নগরের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। শিউলির মা সাবিয়া বেগমও মেয়ের সঙ্গেই থাকেন।

শিউলির বাবার বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মুক্তারপুর খলিফাপাড়া গ্রামে। সরদহ ট্রাফিক মোড়ে তার বাবা জাহাঙ্গীর হোসেনের একটি চায়ের দোকান ছিল। এটিই ছিল শিউলিদের পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস। সেই চায়ের দোকানটিও একসময় পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। তার শিক্ষা জীবনের শুরুই হয়েছে যেন অবহেলার মধ্য দিয়ে। পড়ার জন্য এক শিক্ষকের বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে তার মাকে একটি ভাঙা চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদের বসানো হয়েছিল ভালো জায়গায়। তার শিশু মনে এটি তখন দাগ কেটেছিল। তখন থেকেই তার জেদ, যে কোনো মূল্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু অভাবের সঙ্গে দৈনিক তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ভাঙা ঘরে বৃষ্টির রাতে ঘুমানো যেত না। না খেয়েও স্কুলে যেতে হয়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বৃত্তির টাকা দিয়েই পড়ার খরচ চালাতে হয়েছে।

এ অভাবের কারণেই নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার আগের দিন রাতে হঠাৎ তার বিয়ে হয়ে গেল। এসএসসি পাস স্বামী তখন একটি বাল্ব কোম্পানিতে চাকরি করতেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বামীর সেই চাকরিটাও চলে গেল। এসবের মধ্যেই ২০১১ সালে সরদহ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় শিউলি পেলেন জিপিএ-৫।

রাজশাহী কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরও যাতায়াত খরচের টাকার কথা ভেবে সেখান ভর্তি হননি। শ্বশুরবাড়ির কাছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজে ভর্তি হলেন। তখন তার স্বামী রাশেদুর রহমান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষতে (বিএমডিএ) মাসিক দেড় হাজার টাকার একটি কাজ পান। এ সময় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বাধার মুখে শিউলির পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তারা বাড়ির বউকে পড়াশোনা করতে দিতে চান না। পড়াশোনা বন্ধ করতে তার ভাত বন্ধ করে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর আচরণও করেছে তার পরিবারের লোকজন। স্বামীর পাশে বসেই শিউলি শোনাচ্ছিলেন তার জীবনের এ নিষ্ঠুরতার গল্প। স্বামীও স্বীকার করলেন, স্ত্রীর পক্ষ নেওয়ায় সে সময় তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন রাশেদুর।

২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় শিউলি আবারও সব বিষয়ে এ প্লাস পেলেন। ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল মেডিকেলে পড়বেন। প্রথমবার হলো না। দ্বিতীয়বার অল্প নম্বরের জন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ হলো। এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর স্থানীয় একটি পত্রিকায় খবর হয়েছিল ‘অর্থের অভাবে কি শিউলি ফুটবে না?’ খবর শুনে অনেকেই ছুটে গেলেন কিন্তু বিবাহিত মেয়ের কথা শুনে পরে কেউ সাড়া দেননি।

শিউলি বলেন, এটা তার জীবনের সবচেয়ে হতাশার সময়। তীরে এসে তরি ডুবে যাওয়ার মতো দশা। নিজেরা কিছুই করতে পারছেন না। স্বামীর বেতনটা শুধু দেড় হাজার থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। এমন সময় একদিন বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামসুদ্দিন শিউলির খবর নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠালেন। সব শুনে শামসুদ্দিনই তাকে বারিন্দ মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। শুধু ভর্তি না, শিউলির পড়াশোনার খরচের (প্রায় ৩০ লাখ টাকা) পুরো দায়িত্ব নিলেন তিনি।  পড়াশোনার বাইরেও বাসার বাজার, টুকটাক দরকারি জিনিসপত্র নিয়মিত কিনে দিয়েছেন।

মেডিকেল কলেজে ভর্তির পরই ২০১৫ সালের ৭ জুন ছেলে সন্তানের জন্ম দেন শিউলি। ১৫ দিন পর থেকেই পেটে বেল্ট বেঁধে ক্লাসে যাওয়া শুরু করেন শিউলি। একটাই লক্ষ্য, ডাক্তারি পড়া শেষ করতেই হবে।

শিউলির ভাষায়, ‘অনেক দিন না খেয়ে কলেজে এসেছি, স্যার নাশতা করিয়েছেন। ২০১৬ সালে এমডি স্যার (মো. শামসুদ্দিন) আমার স্বামীকে এই মেডিকেল কলেজে চাকরি দিলেন। কর্মচারীর স্ত্রী বলে ব্যাচের কেউ স্টাডি গ্রুপে নেয়নি। প্রথম বেঞ্চে বসলে সে বেঞ্চে আর কেউ বসতেন না। পেছনে গেলেও একাই বসতে হতো। ক্যানটিনেও একই অবস্থা হতো। এমনও দিন গেছে সহপাঠীদের মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে এমডি স্যারের কাছে গেছি। তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। এইটুকু না পেলে আমাকে হয়তো আত্মহত্যা করতে হতো। আমি জেনেছি, এমডি স্যার এভাবে আরও অনেক অসহায় শিক্ষার্থীর জীবন পাল্টে দিয়েছেন। আজীবন তিনি আমার বাবার জায়গায় থাকবেন।’

১ ফেব্রুয়ারি থেকে শিউলির ইন্টার্নশিপ শুরু হবে। ইতিমধ্যে শিউলির স্বামীও বিএ পরীক্ষা দিয়েছেন। শিউলির ইচ্ছা স্বামীর এমএ ডিগ্রি হওয়ার পরে তাকে একটা ওষুধের দোকান করে দেবেন। আর পুরোপুরি ডাক্তার হওয়ার পর মানুষের সেবায় নিজেকে সঁপে দেবেন। নিজে যেমন কষ্ট পেয়ে বড় হয়েছেন, সেই রকম কষ্টে থাকা মানুষের জন্য কিছু করতে চান। ভেবেছেন, গরিব ও অসহায় মানুষের সেবা দেবেন বিনা মূল্যে। যেভাবে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন একজন মানুষ।

মন্তব্য করুন