
লেখক – এন.এন.নিঝুম
অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে এক কাপ কফি খায় রাকিব, এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আজকেও খাচ্ছিল, এমন সময় রূপা এসে ফোনটা দিয়ে গেল ক্রমাগত টেক্সট আসছে। দূর্দান্ত সুন্দরী আর প্রবল ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন রূপা কখনোই স্বামীর ব্যাক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায় না। হাত বাড়িয়ে ফোন টা নিল রাকিব। নিতু টেক্সট করছে- মুখ তুলে বলল রাকিব,” নিতু আমার স্কুলের ফ্রেন্ড শফিকের ওয়াইফ, আজ একটা কাজে ব্যাংকে এসেছিল, থ্যাংক্স জানাতে টেক্সট করেছে”। ও আচ্ছা বলে রূপা রুমে চলে গেলো।
অকারণে সন্দেহ করা রূপার স্বভাব না তবুও রাকিব কেন বোকার মত কৈফিয়ত দিতে গেল জানে না।
রাকিব, ব্যাংকার, থার্ড জেনারেশান একটা প্রাইভেট ব্যাংকের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা সে। ছোটবেলা থেকেই স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েছে, লম্বা সুদর্শন সে। বয়স ৩৫। বছর পাচেঁক আগে তার প্রফেসরের মেয়ে কর্পোরেট কর্মকর্তা রূপাকে বিয়ে করেছে সে, স্মার্ট সুন্দরি আর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রূপাকে রাকিবের শিক্ষক মা ই পছন্দ করেছেন।
যে-ই দেখে সেই বলে মানিক জোড়।
প্রফেসর শ্বশুরের দেয়া ফ্ল্যাটে থাকে তারা, রাকিব, রূপা আর ছোট রোদসী। দিনের বেলা ডে- কেয়ার আর রাতে মার কাছে। রাকিব শুনেছিল মেয়েরা নাকি বাপের নেওটা, তার মেয়েটাও তার কাছে ঘেষে না। রূপা ব্যাক্তিত্বের কাছে কোথায় যেন বরাবর হার মেনে থাকে রাকিব। না রূপা ডোমিনেটিং না, রাকিব একটু ইন্ট্রোভার্ট, তার ধারনা সে ভুল সময়ে জন্মেছে, তার আরো ৩০ বছর আগে মফস্বলে কোথাও জন্মালে ভাল হত। মার্কেটিং এর তুখোড় ছাত্র রাকিবের প্রিয় বিষয় সাহিত্য, তার প্যাশান লেখালেখি আর গান। রূপার একেবারেই ইন্টারেস্ট নেই এসবে। উইকএন্ডে রাকিবের পছন্দ বাসায় বসে মুভি দেখা আর প্রিয় গান শোনা। রূপা চায় তার মায়ের দিকের বা কলিগদের বিভিন্ন পার্টি এটেন করতে। মাঝে মাঝে রাকিব ও যায় রূপা আর রোদসিকে খুশি করতে, বেশিরভাগ দিন ই তার ঘুম পায়। প্রায়ই দেখা যায় কোনার দিকের কোন সোফায় হা করে ঘুমাচ্ছে। রূপা ভেবে পায়না, এমন জমজমাট পার্টিতে এত শব্দের মাঝে একটা লোক এমন নাক ডেকে ঘুমিয়ে যায় কি করে। ইদানীং আর তাই রাকিবকে নেয় না সে। এই রাত গুলা রাকিবের খুব প্রিয়, সে অনেক রাত অবধি প্রিয় গান শোনে, বই পড়ে, লেখে। মাঝ রাতে ওরা ফিরে এলে ঘুমায় পরদিন দুপুর অব্দি। রূপা স্ত্রী হিসাবে দায়িত্বশীল, বাসায় কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও সকালে পাশে বসে ব্রেকফাস্ট করিয়ে অফিসে পাঠায় রাকিব কে, অবশ্যই দুপুর ২ টা থেকে ২.৩০ টার মাঝে ফোন করে লাঞ্চ করেছে কিনা রাকিব সেটা ইনশিওর করে। সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে ফিরে নাশতা খায় একসাথে। কিন্তু রাকিবকে ওর কাছে খুব গোমড়ামুখো কিছুটা খ্যাত আর ওল্ড ফ্যাশন্ড লাগে। তার বাবার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল রাকিব, সেই সূত্রেই বিয়ে। রূপার সবসময় মনে হয় আন্ডাররেটেড একটা ছেলেকে সে বিয়ে করেছে। যদিও রাকিবের ক্যারিয়ার বা পারিবারিক অবস্থান কোন দিক দিয়েই তাদের চেয়ে কম নয় ওরা, তবুও রূপার রাকিবকে কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত লাগে।
অন্যদিকে রাকিবের মনে হয় সে যেন কখনোই পায় নি রূপাকে, কখনোই নিজেকে রূপার সামনে মেলে ধরতে পারেনি সে, খুব আধুনিকা রূপার সাথে তার রুচির পার্থক্য যোজন যোজন।
তার পুরানো গানের রুচি, সাহিত্যের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ বরাবরই রূপার অবজ্ঞার বিষয়ে পরিনত হয়েছে। আরো বেশি গুটিয়ে গেছে রাকিব। আশ্চর্যের ব্যপার হল তাদের কখনো ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি হয়নি। রাকিবের খুনিশুটি রূপার এত বিরক্ত লাগত যে রাকিব আরো দূরে সরে থাকতে লাগলো। নিজের একটা একাকী জগতে কেন্নোর মত ঢুকে থাকে সে। অফিস বাসা এই তার জীবন। বাসায় থাকলে হেড ফোনে গান। সপ্তাহে একদিন নিয়ম করে বৈবাহিক সম্পর্ক ঝালাই রুটিন। সেখানেও কোন ছন্দ পায় না রাকিব। বন্ধুদের কাছ থেকে কেন যেন নিজেই পালিয়ে থাকে রাকিব। যদিও সবার ধারনা সুন্দরি সফল বউ আর মোটাবেতনের চাকরির অহংকারে পা পড়েনা রাকিবের।
আজ হঠাৎই তার স্কুলের বন্ধু শফিকের ফোন, তার ব্যাংকে শফিকের শ্বশুরের কিছু টাকা এফ ডি করা ছিল, শ্বশুরের মৃত্যুর পর ওর ওয়াইফ ই একমাত্র ওয়ারিশ তাই টাকা তুলতে যাবে শফিকের বউ নিতু। শফিকের রিকোয়েস্ট রাকিব যেন নিতুকে হেল্প করে, অনেক বড় মুখ করে বন্ধুর কথা বলেছে নিতুকে।রাকিব নিশ্চিন্তে থাকতে বলে শফিককে। স্কুলে শফিকের নাম ছিল হোলি কাউ। অত্যন্ত সরল ছিল মধ্যবিত্ত শফিক।
শফিকের বউ নিতু সালাম দিয়ে রাকিবের কেবিনে ঢুকলো, রাকিব তার এক জুনিয়র স্টাফকে ডেকে সব ক্লিয়ার করে দিতে বলে মিটিং চলে গেল। যাবার আগে অনেকবার সরি বলেছে সে নিতুকে। মিটিং শেষ করে এসে অবশ্য নিতুকে আর পায় নি, কাজ সেরে চলে গেছে বাসায়। সন্ধ্যায় থ্যাংক্স জানাতে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছিল রাকিব কে
আমাদের গল্প শুরু এখানে থেকে।
‘আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া থ্যাংক্স’
‘ইটস অল রাইট, আমি সরি থাকতে পারিনি বেশিক্ষন’
‘না ভাইয়া, খুব উপকার হয়েছে আমার’
‘নিতু শফিক কে নিয়ে একদিন বাসায় আসবেন’
‘ভাইয়া তার পোস্টিং তো কুমিল্লায়, আপনি জানেন না।’
‘সরি জিজ্ঞেস করা হয় নি’
গল্প এগিয়ে যায়। রাকিব ভীষন অবাক হয়, নিতুর সব পছন্দ ঠিক তার মতো। নিতুও কবিতা খুব ভালবাসে এবং তাদের প্রিয় কবি ও একই- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। রাকিব আর নিতু কবিতা নিয়ে প্রতিদিন রীতিমতো ঝড় তোলে ম্যাসেঞ্জারে। রূপা তার রুটিনে ব্যাস্ত। রাকিব যেন একটু একটু করে প্রাণ ফিরে পায় নিতুর সাথে বন্ধুত্বে। এর মাঝে দুইবার শফিক ঢাকায় আসলে ঘুরে এসেছে ওদের বাসা থেকেও। রাকিব খুব অবাক হয়, নিতু মেয়েটা কিভাবে যেন টের পেয়ে যায় তার প্রিয় পছন্দের সব। রান্নার সময় কী করেই বা বোঝে ভুনা খিচুড়ির সাথে অবশ্যই জলপাইয়ের আচার লাগে রাকিবের। কিভাবে সে যেন জেনে যায় আজ লাল শাড়িতেই দেখতে চাচ্ছিল রাকিব তাকে। শফিকের সাথে আড্ডা তেমন যমতো না রাকিবের, ফিজিক্সের প্রফেসর শফিক কখনোই ওদের কথার মাঝে আগ্রহ পেত না, সে চলে যেত ঘুমাতে/রেস্ট করতে। আড্ডা জমতো রাকিব আর নিতুর। আড্ডা দিতে দিতে প্রায় মাঝরাত হয়ে যেত প্রায়ই। রার ১১ টায় অবধারিত রূপা ফোন- বাসায় আসো। অগত্যা আদর্শ স্বামীর মত হৃদয় পূর্ণ করে ফিরে যেত নিজের ঘরে। আর নিতু আর নার্ড স্বামীর পাশে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলত কোন এক আরাধ্য রাকিবের জন্য, যাকে পাওয়া যাবেনা জেনেও অর্জনের তীব্র বাসনা অনুভব করতো নিতু।
ইদানীং রাকিব খুব খুশি খুশি থাকছে। অফিসে যাওয়ার আগে রূপার উপর ভরসা না করে দুইবার আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। প্রিয় পারফিউম টা স্প্রে করে কানের পেছনে। রাকিব এখন জীবনের প্রতি তীব্র আগ্রহ অনুভব করে। অফিসে কাজের ফাকেঁ অজস্রবার চেক করে ম্যাসেঞ্জার।
কী অদ্ভুত ভাল লাগায় ভরে থাকে তার মন। বেনামে কবিতা লেখাটা খুব বেড়েছে তার। লিখার সাথে সাথেই তার চাই নিতুর ফীডব্যাক। ম্যাসেঞ্জারে না পেলে নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে সন্ধ্যায় নিতুর বাসায়। জয়েন ফ্যামিলির বউ নিতুকে ৫ মিনিট কাছে পাওয়াও টাফ। তবু রাকিব সব অগ্রাহ্য করেই যায় নিতুর বাসায়। আজ দূর্দান্ত একটা কবিতা লিখেছে সে, নিতুকে শোনাতেই হবে। সকাল থেকে ম্যাসেঞ্জারে মহারাণি অফলাইন। ফোনেও পাচ্ছেনা। আষাড়ের বৃষ্টিতে আজ তার ব্যাংকে কাজ ও কম। রাকিব তাই একটু আগেই পৌছে যায় নিতুদের বাসার সামনে। শফিকদের মগবাজারের এই বাসাটা অনেক পুরানো। গাড়িবারান্দা পার হয়ে দোতালায় শফিকেএ ফ্ল্যাটের সামনে আসতেই কারেন্ট চলে যায়। পুরানো এই বিল্ডিং এ জেনারেটর ও নেই। দরজায় নক করে রাকিব। পুরানো ধ্যান ধারনায় চলা শফিকদের বাসায় সাধারনত গেট খোলেন শফিকের বাবা কিংবা কাজের খালা। কিন্তু আজ রাকিবকে অবাক করে দিয়ে গেট খোলে নিতু, হাতে মোমবাতি। নিতুর চুল ভেজা, আর সে ভেজা চুক থেকে আসছে ডাভ শ্যাম্পুর তীব্র ঘ্রাণ(যেটা সে পরে জিজ্ঞেস করে জেনেছে)। রাকিবের মনে হতে থাকে এই দৃশ্য কোন পার্থিব জগতের না, নিতু কোন স্বর্গের অপসরি। বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে রাকিব। হাটুঁ গেড়ে বসে নিতুর সামনে।
নিতু দু’পা পিছিয়ে যায়, রাকিব কাপাঁ গলায় বলে উঠে নিতু আমি তোমাকে ভালবাসি। এরপর আর কোন কিছু মনে নেই রাকিবের, ঘোর লাগা সে সন্ধ্যায় রাকিব নিজেকে আবিষ্কার করে নিতুর মাঝে নতুন করে, নিতুও গ্রহন করে রাকিব কে প্রবল আবেগে। যখন ঘোর কাটে তখন বাসা থেকে রূপার ফোন, বৃষ্টির মাঝে কোথায় তুমি, বাসায় আসো। নিতুর উষ্ণতা ছেড়ে বাড়ী ফিরে রাকিব। আর নিতু….রাকিবের ঘোরে হারিয়ে ভুলেই গিয়েছিল আজ বাসায় একা সে…….
Waiting for next.
[…] সাঁঝের বেলা (পর্ব – ১) […]