ইউরোপের ডায়েরিঃ সুইডেন (মালমো)-পর্ব ০৩

লেখক- এন এন নিঝুম

( দ্বিতীয় পর্বের পর থেকে)

ডর্মে শুরু করা আমার জীবন কার্যত ভীষন এক্টিভ হয়ে পড়লো, কারন বাজার করার ঝক্কি, রান্না করা, ক্লাস এইসব নিয়ে আমি বেহাল। এর মাঝে আমার রুমমেটের আজব সব অভ্যাস আমাকে সারারাত ঘুমাতে দিত না। উনি সারারাত টিভি ছেড়ে রাখতেন, ওয়াশরুমে দরজা খোলা রাখতেন, আমাদের রুমটা ছিল ৯ তলায় উনি হেটেঁ নয় তলায় উঠতেন। পরে বুঝেছি উনার ছিল Clustrphobia. আমি কেমন যান হতবুদ্ধি হয়ে পড়ছিলাম। এক উইকেন্ড সুমি আমার ফ্ল্যাটে এসে আমার হতবুদ্ধি চেহারা দেখে ওর বাসায় নিয়ে গেলো দুইদিন থাকব ওদের সাথে। খুব ভাল ঘুমালাম দুইদিন, এর মাঝে এক শনিবার বিকালে বেড়াতে গিয়েছিলাম পিল্ডেমস পার্কে। লেকের স্বচ্ছ জলে নানারকম হাসেঁদের জলকেলী আমার মনের মাঝে জমে থাকা অবসাদ ভুলিয়ে দিও। ১৯১৪ সাথে প্রতিষ্ঠিত বিরাট এই পার্ক, আজন্ম ঢাকায় বড় হওয়া আমি এই বিশাল পার্ক দেখে মুগ্ধ হয়ে বুঝেছিলাম কী ক্ষুদ্র আমার জানার-দেখার পরিব্যাপ্তি আমার! কি অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘাড় উঁচিয়ে অহংকারি ভংগীতে চলা রাজহাঁসের দল। দৌড়ে বেড়াচ্ছে খোরগোশ- সাদা, গ্রে, কালো। আমি, সুমি, আপু আর ছোট্ট যাহরা খুব খুব আনন্দ করেছিলাম সেদিন। হাসেঁদের খাইয়েছিলাম ছোট ছোট ব্রেড। প্রাপ্তির একরাশ তৃপ্তি নিয়ে ফিরেছিলাম আমার ডর্মে। তখন ছিল রমজান মাস, সে বছরের রোজাগুলো রাখা হয়নি আমার। এরমাঝে মুসলিম স্টুডেন্ট ফডেরেশান আর বাংলাদেশ স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন এর ইফতারির আয়োজনে অংশ নিয়ে জেনেছি দুনিয়ায় তাবৎ মুসলমান আসলেই ভাই ভাই।

ডর্মের দিনগুলী দুঃসহ হয়ে যাওয়ায় সুমির বাসায় শিফট করি আমি। সুমি আর সুমির বোন আমকে তখন সাপোর্ট না দিলে আমাকে হয়ত ফিরে আসতে হত দেশে।

ক্লাসগুলো ছিল অসাধারণ। ক্লাসে আমার একজন বন্ধু হলো -“হুমায়েরা(হুমা) জাতিতে চাইনিজ, মুসলিম)। আজ পর্যন্ত সে আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ডদের একজন। হুমা আমার মতই দেশ কে মিস আর নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছিল। ক্লাসের পর আমরা খুব আড্ডা দিতাম কুংগেন্সপার্ক আর ভাস্ত্রা হেম্মানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ানোর ধরনের থেকে খুব বেশি রকম আলাদা। ভীষন সুপুরুষ একজন শিক্ষক ক্লাসে ঢুকেই বলতেন “In my classes you have freedom, but remember where there is freedom, there must be Responsssibility”.  কিছু কিছু লেকচার বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল, তবুও পার পেয়ে যাচ্ছিলাম। প্রথম কোর্সের পরীক্ষা Theory of International Politics, ঠিক এই কোর্স্ আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সেও ছিল। আমি খুব কনফিডেন্ট ছিলাম। রোজ নিয়ম করে লাইব্রেরিতে ৮ /১০ ঘন্টা পড়ছিলাম আমি আর হুমা। প্রথম পরীক্ষা, হলে গিয়ে দেখি কী রিল্যাক্স মুড সবার, অনেকে কফি/ড্রিংক্স নিয়ে এসেছে। ও একটা কথা বলা হয় নি সুইডেনে ক্লাসগুলো খাবার(স্ন্যাকস) নিয়ে ঢোকা যায় এবং ক্লাস ভাল না লাগলে বেরিয়ে যাওয়া যায়, সব চেয়ে অবাক হয়েছিলাম দেখে।টিচারদের(তা যে বয়সীই হোক) নাম ধরে ডাকা যায় এবং মেইল করলে এরা উত্তর দেয়। গিয়ে।দেখি ওপেন বুক এক্সাম, মেকিয়াভেলিয়ান প্রিন্সের ইন্টারপ্রেটেনশন করতে হবে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের পরিপ্রেক্ষিতে। সম্পর্কের ছাত্র আমি, প্রিন্স আমি কয়েকবার গুলে খেয়েছি, কিন্তু প্রশ্নের শেষাংস দেখে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেলাম, প্রিন্সের সমালোচনা করতে হবে মার্ক্সের অথবা ইমানুয়েল কান্তের দৃষ্টিকোন থেকে। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে ডাকতে কোন রকমে এক্সাম শেষ করলাম। এক্সাম শেষে সেদিন হুমা কেন যেন খুব তাড়াহুড়া করে কোথায় চলে গেলো। আমার মন খুব উদাস হয়ে পড়লো। বাসায় ফিরলাম। আজ বাসা অস্বভাবিক চুপচাপ লাগছে, রোজ নিচ থেকে দোতালায় উঠার সময় জাহরার চিৎকারে কান।পাতা দায় হয়ে যায়, আজ মনে হয় ঘুমিয়ে আছে।

আমার কাছে থাকা চাবি দিয়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। কিন্ত একি!

মন্তব্য (2)

মন্তব্য করুন