
গতকাল পুরান ঢাকা এ পালন হলো শত বছরের ঐতিহ্যবাহী উৎসব সাকরাইন। নানা সাম্প্রদায়িক দন্দ সংঘাত উত্তেজনার মাঝেও পৌষ সংক্রান্তি বা সাকরাইন এই শহরে হিন্দু মুসলিম সবার সার্বজনীন এক সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে আজও টিকে আছে।
ছোট বড় সবার অংশগ্রহণে মুখরিত হয় প্রতিটি বাড়ির ছাদ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে আকাশে ঘুড়ির সংখ্যা ও উৎসবের মুখরতা। সাকরাইন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় পুরান ঢাকার নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবারের। সাকরাইন উপলক্ষে পুরান ঢাকার আকাশে শোভা পায় নানা রঙ আর বাহারি আকৃতির ঘুড়ি। এ ছাড়াও আগুন নিয়ে খেলা, আতশবাজি ফোটানো এ উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। তবে সকালের তুলনায় বিকেলে এ উৎসব বেশি মুখরিত হয়। সাকরাইন উৎসবকে পৌষসংক্রান্তি বা ঘুড়ি উৎসবও বলা হয়। এ উৎসবে অংশ নেন সব ধর্ম, পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ।
আজ চলুন জেনে আসি সাকরাইন বা পৌষ সংক্রান্তির ইতিহাস।
ঢাকায় পৌষসংক্রান্তির এ দিনকে বলা হয় সাকরাইন। ঢাকাই ভাষায় ‘হাকরাইন’। আদি ঢাকাই লোকদের পিঠাপুলি খাবার উপলক্ষ আর সাথে ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতার দিন। সাকরাইন একান্তই ঢাকার, যুগের পরিক্রমায় তাদের নিজস্ব উৎসব। এটা বাংলাদেশের কোথাও পালিত হয় না। যা ঢাকার জনপ্রিয় ও দীর্ঘ সাংস্কৃতিক চর্চার ফল।
সাকরাইন শব্দটি সংস্কৃত শব্দ সংক্রাণ থেকে এসেছে। আভিধানিক অর্থ : বিশেষ মুহূর্ত। অর্থাৎ বিশেষ মুহূর্তকে সামনে রেখে যে উৎসব পালিত হয় তাকেই বলা হয় সাকরাইন। এই সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেক দেশেই এই উৎসব পালন করে। তবে ভিন্ন ভিন্ন নামে। এই উৎসবের দুটো দিক আছে। একটি ধর্মীয় অপরটি সাংস্কৃতিক।
সংক্রান্তির এই উদযাপন কবে থেকে চলে আসছে তা সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। হতে পারে হাজার বা তারও আগের পুরনো এ মকর সংক্রান্তির মহাতিথি।
মকর সংক্রান্তি বা পৌষ মাসের শেষ দিন হিন্দু জমিদারেরা তাদের জমিদারিতে ব্রাহ্মণ ও প্রজাদের আতিথেয়তা দেন। উন্মুক্ত মাঠে ভোজ উৎসব হয়। বিতরণ করা হয় চাল, গুড়, তেলের তৈরি পিঠা ও ডাবের পানি। এটি বাস্তু পূজা নামে পরিচিত। এ উপলক্ষে বিক্রমপুরে কুস্তি, লম্বদান ইত্যাদি প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। এই হলো সংক্রান্তির ধর্মীয় দিক।
পৌষের বিদায় ক্ষনটি অর্থ্যাৎ শেষদিন হল এই লড়াই ও পিঠাপুলি খাওয়ার উৎসবের দিন। আবার ঢাকার তাতিবাজার ও শাখারিবাজারের হিন্দু সম্প্রদায় এই ঘুড়ি খেলার উৎসবটি ১লা মাঘ মেনে একদিন পরে পালন করে। সন্ধ্যায় খেলা শেষ হলে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা ঘুড়ি নাটাই সব আগুনে পুড়িয়ে শুভক্ষনকে বরন করে নিত আর মুসলমানরা নাটাই চিলেকোঠায় তুলে রাখতো পরের উৎসবের অপেক্ষায়। সন্ধ্যা নামতেই আকাশে শুরু হত পটকা আর আতশবাজির খেলা। বুড়িগঙ্গার তীর আলোকিত হয়ে উঠত আলো ঝলমলে রঙ্গীন আভায়। ৬০ দশকে যুক্ত হয় মাইকের দাপট। নবাবদের সময় পল্টনে ব্যান্ডের বাজনা বাজিয়ে দুইদলকে উৎসাহ যোগান দেয়া হত। বিবর্তন ও প্রযুক্তি যোগ করছে হাই পাওয়ার সাউন্ড সিস্টেম ও গান। বিরিয়ানি, খিচুরি, কালিয়াও বাদ যাচ্ছে না।
কালের ধারাবহিকতায় উৎসবে অনুসঙ্গের পরিবর্তন এলেও আমেজ ও আবেগটা কিন্তু এখনও প্রজন্মান্তরে রয়ে গেছে ঠিক আগের মতই। যা নাগরিক মনকে বিনোদিতই করত না রেখে যেত পরবর্তী পৌষে দেখা হবার প্রস্তুতির চ্যালেঞ্জ। সাথে নিয়ে যেত ঐক্য আর বন্ধুত্বের বার্তা। পালিত হচ্ছে ঐক্য ও বন্ধুত্বের প্রতীক হয়ে।