
লেখক- এন.এন.নিঝুম
সুইডেনের প্রথম সকালটি আমাকে বিমোহিত করে ফেলল তার চমৎকার নরম রৌদ্রজ্বল নান্দিকতায়। বাইরের জানালায় উকিঁ মারতেই অবাক হয়ে দেখলাম দোয়েল পাখি, জ্বী হ্যা রবিন কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বড় সাইজের। মনটা আদ্র হয়ে উঠলো। ঠিক এমন সময় আমার নতুন ফোনে সুইডেনের নাম্বারে ফোন দেখে চমকে উঠলাম, দেশ থেকে আসা ফোন। ভাল আছে বাংলাদেশ, ছোট্ট সাইজের দোয়েল পাখি গুলো আমাকে মিস করে কিনা জানা হলো না।
সুমি একদম ঘড়ির কাটাঁ ধরে ১০টায় হাজির। আমার চির উচ্ছল বন্ধুটি আমাকে পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আমাকে নিয়ে প্রথমেই গেল সোদারভানের কাছে একটা কারেন্সি কনভার্টার শপে সেখানে থেকে দুই বন্ধু চললাম বাস এর টিকেট করতে। অবাক হলাম শুনে এখানে সারা মাসের জন্য বাসের টিকেট করা যায়, একবার টিকেট করো, তারপর মালমো শহরে যত খুশি চক্কর লাগাও (মাসব্যাপী) বাহ দারুন তো। বাসের টিকেট হয়ে গেলে গেলাম আমার ডেস্টিনেশান মালমো ইউনিভার্সিটিতে, আইডি কার্ড, ইউনিয়ন কার্ড, লাইব্রেরি কার্ড সহ আনুষঙ্গিক কিছু কাজ সুমির অসামান্য দক্ষতায় ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই হয়ে গেল। ততক্ষনে পেটে ছুচোঁ দৌড়াচ্ছে, সুমিকে বললাম চল রেস্টুরেন্টে যাই, সুমি আমার বয় কাট চুলে চাপড় মেরে বলল দেশের টাকা এনে এখানে বিলাসিতা করতে পারবো না, দিবও না। চল বাসায় চল। অগত্যা দুপুরের লাঞ্চ সুমির সাথে সুমির বাসায়। সুমির বাসায় সুমির বড় আপু আর ৬ বছর বয়সী ছোট্ট যারা। খুব আড্ডা হলো সন্ধ্য পর্যন্ত। এরপর ফিরে এলাম বাংগালী ভাইয়ের বাসায়। ভাবি খুব দারুন মানুষ ছিলেন। ভাইয়া কোন কারনে আমাকে পছন্দ করলেন না বলেই মনে হয়েছিল আমার।
পরদিন সুমির কাজ আছে, তাই বলল ঘুরে ফিরে শহরটাকে দেখতে।।সমস্যায় পড়লে যেন ফোন দেই। ও ভাল কথা, সুমির গিফট করা সিমে একই অপারেটরে সব কল ফ্রী। তখন স্মার্ট ফোন আসেনি, তাই দেশে ফোন করতে হত এক লোকাল শপ থেকে। মনের মাঝে আকুল হয়ে থাকা প্রিয়জনদের কন্ঠ শোনার জন্য আমি যে দিনে কতবার ঐ দোকানটাতে যেতাম। যাই হোক, এডভেঞ্চারের উদ্দেশ্যে উঠে বসলাম বাসে উদ্দেশ্য বাসের শেষ স্টপেজে যাওয়া। সোদেরভান স্টপেজে এসে থামলাম, এরপর আগের দিনের মেমোরি রিকল করে ২ নাম্বার(নাম্বার টা ভুল হতে পারে) বাসে চেপে চলে গেলাম আমার ইউনিভার্সিটির ঠিক পাশে ওরেসুন্দ সমুদ্রের পাড়ে। বাস থেকে নামতেই গ্রে কালার দুটো খরগোশ আমাকে স্বাগত জানিয়েই দৌড়ে পালালো।
আহা! কী অপুর্ব সৌন্দর্য সেখানে। আমি সমুদ্রের পাশে বসলাম, আমার দুচোখ বেয়ে তখন অশ্রু, দেশে ফেলে আসা কারো জন্য হয়তো ভীষন আকুল হয়েছিল মন। অনেক্ষণ হাটলাম আমি। সমুদ্রের পাড়ে খুব শীত লাগছিল অথচ খুব ভাল ও লাগছিল। কী গোছানো তাদের সমুদ্রে ধার। ও বলা হয় নি, আমার ইউনিভার্সটির লাইব্রেরিটা এই সমুদ্রেরই পাশে, সে গল্প আরেকদিন বলব। সমুদ্রে বিশালতায় আমি যেন আরো শূণ্য হৃদয় হয়ে পড়লাম। মন খারাপের দিনে আমার অস্থায়ী ঠিকানায় ফিরে একটা ভাল নিউজ পেলাম। একটা শেয়ার্ড ডর্মে আমার থাকার ব্যাবস্থা হয়েছে। দ্রুতই উঠে গেলাম সেখানে। এবং সে অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর হলো না।
এর মাঝে চলে এল বিশ্ববিদ্যালয় ওরিয়েন্টেশন উইক। দাররুন সব সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল আমার জন্য…..
মালমো বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করেছিল ৭ দিন ব্যাপী ওরিয়েন্টাশান উইক। আমার জন্য সারপ্রাইজ প্রথমটা হলো এই সাতদিন ব্যাপী চমৎকার সব আয়োজন। সকাল সকাল চলে গেলাম ক্যাম্পাসে, এডমিন অফিস থেকে সারাদিন ব্যাপী কর্মসূচির ডিটেইল নিয়ে রওনা হলাম আমার ডিপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে সেটা আবার অন্য এক বিল্ডিং এ। ঢুকতেই মনটা ভাল হয়ে গেল, আন্তর্জাতিক ছাত্রদের অভ্যর্থনার দুর্দান্ত আয়োজন করেছে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন। স্টুডেন্ট ইউনিয়ন কত কার্যকরি একটা প্রতিষ্ঠান তা আমি সুইডেনে পড়তে না গেলে জানতাম না। যাই হোক আমার ডিপার্টমেন্টে( Global Political Studies) এর অরিয়েন্টেশান ক্লাসে যে চমকপ্রদ তথ্যটি জানা গেল, তা হলো টোটাল ৪১ টো দেশের ছাত্ররা রয়েছে আমার ক্লাসে। সবার পরিচিতি পর্বের পর কোর্স সিলেবাস তুলে দিয়ে ফেস্ট শুরু হলো। আকর্ষণীয় দেখতে সব খাবার কিন্তু কোনটাই খাবার উপোযোগী না😥😥 রীতিমতো অখাদ্য।
যাক এরপর নিচতলায় গেলাম, দেখলাম সারি সারি বুথে ছাত্রদের জন্য নানান অফার, কেউ দিচ্ছে ফ্রী সিম, কেউ আপেল, কেউ ড্রিংস, আমি কয়েক ক্যান কোক, অনেকগুলো রাইটিং প্যাড, কলম আর প্রায় এক ব্যাগ মাফিন তুলে নিলাম। ওরিয়েন্টেশন উইকে আরেকটা দারুন জিনিস ছিল গাইডেড সিটি ট্যুর, মালমো শহর কে নতুনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। খুব খুব আনন্দ পেয়েছিলাম সেই ট্যুরে। ট্যুর টি শেষ হয়েছিল মালমো অপেরায়, সেখানে ছিল বর্নাঢ্য বুফের আয়োজন। আমার জীবনে খাওয়া কুৎসিততম খাবার ছিল সেগুলো। একমাত্র মুখে দিতে পেরেছিলাম স্যামন মাছের একটা ডিশ, একে তো হালাল/হারামের ভয়ে ৮০‰ডিশ ই আমি টেস্ট করতে পারিনি তার উপর বোতল বন্দী পানি যে ওজোন পানি না কি যেন মুখেই দিতে না পেরে ব্যাগের ভেতর থাকা খালি বোতলে ওয়াশরুমে গিয়ে পানি ভরে খেয়েছিলাম খুব মনে আছে।
প্রচন্ড ক্ষুধার্ত আমি সুমির বাসায় গিয়ে সেদিন হামলে খেয়েছিলাম ভাত আর ডিম ভাজা, আমার জীবনে খাওয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ খাবার আয়োজন ছিল সেটা।
সুন্দর লেখা। ধন্যবাদ লেখক কে
Khub valo likha. Keep it up