চিঠির_শিরোনাম : প্রিয়তমকে না বলা কথা
নাম : সোহরা খাতুন
প্রিয়তমেষু,
যদি আপনাকে ভেবে একটা কবিতা লিখি আপনি কি অবাক হবেন? নাকি হেসে উঠে বলবেন, পাগলি একটা, তুমি আমায় ভেবে কবিতা লিখলে বরং ভালো লাগবে আমার।
যদি কাউকে না জানিয়ে হৃদয়ের মজলিসে আপনাকে বসাই, আপনি কি অবাক হবেন? নাকি বিরক্ত হয়ে বলবেন, এতো বড় অধিকার পাওয়ার যোগ্য তুমি নও।
যদি আপনাকে ভেবে একটা চিঠি লিখি আপনি কি খুব বেশি অবাক হবেন?
হয়তো অবাক হবেন, হয়তো হবেন না। নয়তো আশ্চর্য্য হয়ে বলবেন, এই ফেইসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের যুগেও কেউ চিঠি লেখে?
হ্যাঁ চিঠি, প্রতিদিনের চিঠিতে লেখা অসম্ভব অনুভবের নাম “আপনি”। প্রতিটি চিঠিতে লেখা অসংখ্য শব্দের আন্দোলিত ভালোবাসা “আপনি”।
আঁধারের মাঝে দৃশ্যমান আলো “আপনি”। মলিন ডায়েরির ভাঁজে লেখা প্রতিটি গল্পের চরিত্র “আপনি”। আমার বিমর্ষ ক্যানভাসে আপনি হাজার রঙিন তুলির আঁচড়।
আচ্ছা, আপনার মনে পড়ে আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার কথা? কোনো এক জোৎস্না ঝড়া রাতে আমাদের প্রথম আলাপন হয়েছিল। আপনারা আমায় দেখতে এসেছিলেন। আলাদা একটু কথা বলতে সবার জোরাজোরিতে ছাঁদে এসেছিলাম। সে রাতেও আকাশে এতো বড় একটা চাঁদ উঠেছিল। আপনি সেদিন শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সুরে বলেছিলেন ” তুমি কথা কয়না, তুমি হেটে চলে যাও। এই চাঁদের আলোতে তুমি হেঁসে গলে যাও। আমি ঘুম ঘোরে চাঁদের পানে চেয়ে থাকি মধু বানে, তোমার আঁখি মতোন দুটি তাঁরা, ঢালুক কিরন ধারা। তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তাঁরা।”
আমি প্রতিত্তোরে অনেক্ক্ষণ কিচ্ছু বলতে পারিনি। আনন্দে নিঃশব্দে শুধু কয়েক ফোটা অশ্রু গাল বেয়ে পড়েছিল। নিরবতা ভেঙে শেষে বলছিলাম, “এরপর থেকে প্রতিটি জোৎস্না রাত আপনার সাথে উপভোগ করতে আমার কোনো আপত্তি নেই।” আপনি মুচকি হেসে নিচে নেমে এসেছিলেন।
এখনো রাত হয়, আকাশে জোৎস্না ঝড়ে, চাঁদ ওঠে। তখন আপনাকে এতো এতো মনে পড়ে যে ইচ্ছে করে আপনার কাছে ছুটে চলে যাই। কিন্তু এখন একা একা জেগে থাকা টুকরো নীল জোৎস্না রাতগুলো কেমন যেন বিমর্ষ। বিমূর্ত রাত্রিগুলো কেমন যেন মৌনতার সুতোয় বোনা। চারদিকে এতো আলো তবুও যেন নিকষকালো অন্ধকার লাগে। সবাই আছে তবুও যেন মনে হয় কোথাও কেউ নেই।
জানেন, আপনাকে ভেবে লেখা চিঠিগুলো অনামা ডাকবাক্সে বড্ড অবহেলায় পড়ে আছে। মলিন ডায়েরির পাতায় জমে উঠেছে ধুলো। ধুলোমলিন ডায়েরির ভাঁজে অজস্র শব্দে লেখা অব্যক্ত কথাগুলো কখনোই আপনার ঠিকানায় পৌঁছাতে পারিনি। আমি জানি না, এই চিঠিও আপনার কাছে পৌঁছাবে কিনা। কেন লিখছি, সে উত্তরও আমার জানা নেই। হয়তো লিখতে ভালো লাগে তাই লিখি।
খুব ইচ্ছে করে একদিন আপনাকে চমকে দেই। নিজের ভিতরে ধরে রাখা সব দ্বিধা, সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বলি, “ভালোবাসি, বড্ড ভালোবাসি আপনাকে।”
কিন্তু আমার শরীর নামক বস্তুটা যে এখন ধ্বংস প্রাপ্ত প্রায়। মাঝে মাঝে নিজের উপরই ভীষণ রাগ হয়। কেন আমাকেই গ্রাস করলো মরনব্যাধি?
আমি যে সভ্যতার সভ্য সন্তান হয়ে ভালোবাসায় সিক্ত হতে চেয়েছিলাম। আশ্চর্য্য এক জীবনের ছবি এঁকেছিলাম। নিজের অজান্তেই আপনাকে ভেবে কত-শত যে স্বপ্ন বুনেছিলাম। স্বপ্নগুলো বিলীন হয়ে গেছে। বিলীন হয়ে গেছে মহাকালের অতল গহ্বরে।
প্রিয়তমেষু,
মনের এক গহীনে রেখেছি আপনাকে। যেন ঝিনুকের বুকে মুক্ত, কেউ যেন খুঁজে না পায়। আমার সব ইচ্ছেগুলো তো আপনাকে ঘিরেই ছিল। একসাথে কিছুটা সময় পাশাপাশি হাঁটা, ঝুম বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি বিলাস করা , জোৎস্না রাতের আলোয় দু’জন পাশাপাশি বসে জোৎস্না উপভোগ করা, উত্তাল সমুদ্রের পাড়ে বসে সমুদ্রের গর্জন শোনা। গাড় সবুজ পাহাড়ের চূড়ায় বসে বিকেলের অস্তাচল দেখা, প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য্য দেখে বারবার মুগ্ধ হওয়া। ইচ্ছে তো ছিল, আমাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে, আপনার আর আমার ছোট্ট একটা সংসার। ছোট্ট সাজানো সুখের একটা ঘর। জীবনে প্রথম সমন্ধ, প্রথম ভালো লাগা ছিলেন আপনি। কি করে এতো সহজে ভুলে যাই বলুন তো? তবুও সময়ের পরিক্রমায়
আপনাকে নিয়ে সব ব্যাকুলতা এখন বিমর্ষ। ধীরে ধীরে জাগতিক সবকিছুই এখন কেন জানি ফিকে মনে হচ্ছে। ইদানীং চারপাশের সবকিছুই অর্থহীন মনে হয়। সময় হয়তো বেশি নেই। দ্রুত রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে হয়তো।
জানেন, অসুখের খবরটা শোনার পর খুবই মুষড়ে পড়েছিলাম। প্রচন্ড হতাশায় ডুবে গিয়েছিলাম। কেন আমার সাথেই এমন হলো? এখনো মাঝে মাঝে ভীষণ কান্না পায়। কিন্তু এই অনিশ্চিত দূর্ভাগা জীবনে আপনাকে চাওয়ার সাহস কিংবা যোগ্যতা কোনটাই যে আমার নেই।
কিছু ভালোবাসা হয়তো এমনই, নিরবে আসে আবার নিরবেই চলে যায়। আপনাকেও নিরবে নিভৃতে চেয়েছি কখনো বলা হয়নি। হয়তো আর কখনো বলা হবেও না। পাওয়া আর সেটাকে নিজের মনের মধ্যে ধীরে ধীরে আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা তারপর তাকেই সময় আর পরিস্থিতির কাছে হার মেনে হারিয়ে ফেলাকেই হয়তো ভালোবাসা বলে। সমন্ধটি যেদিন ভেঙে গেল সেদিনও অনেক কেঁদেছিলাম পরক্ষণেই ভেবেছি আমার মতো মরনব্যাধি একটা রুগীর সাথে আপনার জীবনটা না জড়িয়ে বরং ভালোই হইছে। হয়তো অনুভূতিগুলো এক তরফা ছিল। তারপরও আপনার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। নেই কোনো অভিমান। কিন্তু তবুও মন মাঝে মাঝে বড্ড অবুঝ হয়ে যায়, মানতে কষ্ট হয়। আপনার সাথে যে অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছে করে।
যাইহোক, আপনি অনেক ভালো আছেন, সুখে আছেন আলহামদুলিল্লাহ। আমি তো এটাই চাই আপনি সবসময়ই এভাবেই ভালো থাকুন, অনেক সুখে থাকুন। অফুরন্ত দোয়া, ভালোবাসা আপনার জন্য। আপনার যেন সুস্থ, সুন্দর, আপনার মানসিকতার মতো একটা জীবনসঙ্গী হয়।
আর হ্যাঁ, আমি আপনাকে ভালোবাসি। অসংখ্য শব্দের ভিড়ে “ভালোবাসি” শব্দটি যে আপনার জন্যই বুনতে শিখেছি।
ভালোবাসার জন্য কাউকে আপন করে পেতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। দূরে থেকেও আমার ভালোবাসা আপনার জন্য বাধা রবে। নিয়তি হয়তো এমনই ছিল। তবুও সৃষ্টি কর্তার কাছেও আমার কোনো অভিযোগ নেই। দুঃখ শুধু আপনাকে পাওয়া হলোনা। আপনাকে না পাওয়ার শূন্যতা শূন্যতাই রয়ে গেল।
ইতি,
অপরিচিতা