
কলোসিয়াম ইতালির রোম শহরে অবস্থিত একটি বৃহৎ উপবৃত্তাকার ছাদবিহীন মঞ্চ। ৫০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই মঞ্চ সাধারণত গ্ল্যাডিয়েটরদের প্রতিযোগিতা এবং জনসাধারণের উদ্দেশ্যে কোন প্রদর্শনীর জন্য ব্যবহৃত হত। এর অবস্থান রোমান ফোরামের ঠিক পশ্চিমে, যার নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ৭০ থেকে ৭২ খ্রিষ্টাব্দের মাঝে কোন এক সময়; এসময় সম্রাট ভেসপাসিয়ানের রাজত্ব ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় এই স্থাপনার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল ৮০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট তিতুসের রাজত্বকালে। পরে দোমিতিয়ানের শাসনামলে এটির আরও পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়। এর আদি নাম ছিল ফ্ল্যাভিয়ান নাট্যশালা। ষষ্ঠ শতকের পূর্বে ভূমিকম্প এবং অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এটির পুননির্মাণ ও পরিবর্তন সাধন করা হয়। পরবর্তী শতকগুলোতে কলোসিয়াম অবহেলা, ভূমিকম্প ও এর নির্মাতাদের দ্বারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বহির্তোরণের এক-তৃতীয়াংশের বেশি এখনও টিকে আছে।
কলোসিয়ামের ইতিহাস টানতে গেলে অবধারিতভাবে খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ অব্দের কিংবদন্তী সম্রাট নিরোর প্রসঙ্গ চলে আসে। যদিও সম্রাট নিরোর শাসনকালেরও পূর্বে খৃস্টপূর্ব দ্বিতীয় অব্দি থেকে রোমান সাম্রাজ্যের এই এলাকাটা বেশ ঘসবসতিপূর্ন হয়ে উঠেছিলো। ষষ্ট শতাদ্বির মাঝামাঝি সময়ে এসে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে এলাকাটি সম্পূর্ণ ভস্মিভূত হয়। বিপন্ন মানুষেরা পথে বসে যায়। খেয়ালী সম্রাট নিরো এক ফরমান জারী করে সমগ্র উপত্যাকা নিজের মালিকানায় নিয়ে নেন। কুশলী নির্মাতাদের নির্দেশ দেন সুরম্য এক প্রাসাদ নির্মান করতে। নিজের পছন্দ মতো সাজাতে থাকেন পুরো এলাকা। পুড়ে যাওয়া উপত্যাকায় গড়ে ওঠা এই প্রাসাদ ডোমাস ওরিয়া নামে পরিচিত। ডোমাস ওরিয়া অর্থ স্বর্নালী প্রাসাদ। এই বিশার প্রাসাদকে ঘিরে কৃত্রিম লেক তৈরী হয় যার চতুর্দিকে প্যাভিলিয়ন, বাগান এবং ছায়াঢাকা বসার ব্যবস্থা ছিলো। শহরের পানি সরবরাহের জন্য থাকা একুয়া ডাক্টকে আরো বর্ধিত করে এই লেকে নিয়মিত পরিষ্কার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। প্রাসাদের নির্মান শেষে এর সামনে কলোসাস অব নিরো নামে নিজের একটি বিশালাকার ভাস্কর্য স্থাপন করেন। নিরো পরবর্তী সম্রাট ভাস্কর্য থেকে নিরোর মাথা সরিয়ে নিজেদের মাথা সংযোজন করেন। এই ভাস্কর্যকে সম্রাটের বিশালত্ব ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে জনগনের সামনে তুলে ধরার চেস্টা করা হয়। সম্রাটদের মাথার পরিবর্তে একসময় এপরো বা সূর্যদেবতার প্রতীক হিসেবে সোলার ক্রাউন সংযোজিত হয়। বিভিন্ন আলৌকিক ক্ষমতার কথন সহ কলোসাসের অস্তিত্ব ছিলো অনেকদিন। । রোমান সাম্রাজ্যের স্থায়ীত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হেতো।
প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের গোলাকৃতি ও বহুতল অ্যাম্ফিথিয়েটার হিসেবে বৃহত্তম এ স্থাপনাকে ক্রীড়ায় ব্যবহার করা হতো। মল্লবীরগণ একে-অপরকে নিঃশেষ করে স্বীয় ক্ষমতা প্রয়োগপূর্বক নিজেকে টিকিয়ে রাখতো। এমনকি হিংস্র জীব-জন্তুর সাথেও লড়তে হতো তাদের। স্থল-নৌযুদ্ধ, পশু শিকারসম্পর্কীয় নাটকও আমন্ত্রিতদর্শকদের মনোরঞ্জনার্থে প্রদর্শন করা হতো। মহিলাদের মল্লযুদ্ধও অনুষ্ঠিত হতো। অনেক সময় রোমান মহিলারা নামকরা মল্লবীরদের প্রেমে পড়ে গৃহত্যাগও করতেন।
৮০ খ্রিষ্টাব্দে (মতান্তরে ৮১ খ্রিষ্টাব্দে) সম্রাট টিটাস এর শাসনান্তকালে মল্লযোদ্ধা প্রিস্ক্যাস ও ভেরাস এর মধ্যে যুদ্ধ দিয়ে এই স্থাপনার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। বাতিক্রমীভাবে যুদ্ধ অমীমাংসিত থাকে এবং উভয় পক্ষ বিজয়ী ঘোষিত হয়।
১৮০-১৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রোমান সম্রাট কমোডাস এখানে প্রদর্শন করেছেন।
প্রাক মধ্যযুগ থেকে কলোসিয়াম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হলেও মাঝে মাঝে আরো কিছু প্রয়োজনে ব্যবহার হয়েছে যেমন আবাসন, প্রশিক্ষন কেন্দ্র, সৈন্যদের অস্থায়ী ব্যারাক, তীর্থযাত্রীদের আবাসন, এমনকি কোন এক পর্যায়ে দুর্গ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। খৃস্টান সমাধি হিসেবে একসময় কেউ কেউ দাবী করেছেন যদিও এর সমর্থনে খুব শক্ত কোন দলীল নেই। তবে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে এম্পিথিয়েটার কাঠামোর মধ্যে একটি চ্যাপেলের নির্মান করা হয় বলে পাওয়া যায়। এরেনা বা মঞ্চ অংশটি সমাধি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বসার আসন সমুহের নিচের ভল্টেড ছাদাবৃত স্খানগুলি বসবাস এবং ওয়ার্কশপের কাজে ব্যবহার হতে থাকে এবং ১২ শতাব্দী পর্যন্ত এ ধারা চালু ছিলো বলে পাওয়া যায়। অতপর তখনকার প্রভাবশালী ফ্রাঞ্জিপানি পরিবার the Frangipani family) কলোসিয়াম কে দখল করে এবং চারদিকে ঘিরে তাদের দুর্গসদৃশ প্রাসাদ হিসেবে ব্যবহার শুরু করে।